ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস জুড়ে আছে অস্থিরতা; গ্রীক, আর্য, মোঘল, বৃটিশ রাজের ক্রমান্বিত শাসনের পর নানান সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার সংমিশ্রণ এই উপমহাদেশের সংস্কৃতিকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, রাজনীতিকে করেছে ততটাই অস্থিতিশীল। যুগ যুগ ধরে এই অস্থিতিশীলতা এই উপমহাদেশে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, সামাজিক সক্রিয়তাবাদী এবং সচেতন বিদ্রোহীদের। আগের পর্বে বাংলার নারীদের নিয়ে আলাপ হয়েছিল, আজকে আপনাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিব এমন কিছু নারীর সাথে, যাঁরা এসকল কাজের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন।
সরোজিনী নাইডু- ইন্ডিয়ার নাইটিঙ্গেল
সরোজিনী নাইডু হায়দ্রাবাদে ১৮৮৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। লন্ডনের কিং কলেজ ও ক্যামব্রিজের গিরটন কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা করেন। ইংল্যান্ডের suffragist campaign এর অভিজ্ঞতার পরে তিনি কংগ্রেসের আন্দোলনে এবং মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে আকৃষ্ট হন।
১৯২৮ সালে সরোজিনী নাইডু ভারতীয়দের জন্য আফ্রিকা ভ্রমন করেন ও নর্থ আমেরিকায় কংগ্রেসের মুভমেন্টের ব্যাপারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। ১৯২৮-২৯ সালে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকালাপের ফলে তাঁকে কারাবাস করতে হয় বেশ কয়েকবার। ১৯৩১ সালে গোল টেবিল সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে গান্ধীর সাথে তিনি লন্ডনে যোগ দেন।
সরোজিনী নাইডু তাঁর সাহিত্যিক দক্ষতার জন্যও পরিচিত ছিলেন এবং ১৯১৪ সালে তিনি সাহিত্যের রয়াল সোসাইটির সহকর্মী নির্বাচিত হন। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা যিনি রাজ্য গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি ইন্ডিয়ার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিও ছিলেন।
বিজয়লক্ষী পন্ডিত
১৯০০ সালের ১৮ আগস্ট আল্লাহবাদে বিজয়লক্ষী পন্ডিত জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভারতের প্রথম প্রাইম মিনিস্টার জহরলাল নেহরুর বোন।
রাজনীতিতে তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে আল্লাহবাদের পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে বিজয়লক্ষী পন্ডিত ইউনাইটেড প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৩৭ সালে স্থানীয় স্ব-সরকার ও জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী হয়ে ওঠেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হয়েছিলেন।
সকল কংগ্রেসের পার্টি অফিসারদের মতো ১৯৩৯ সালে বিজয়লক্ষী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পদত্যাগ করেছিলেন। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম নারী এবং প্রথম এশিয়ান হিসাবে সেখানে নিযুক্ত হন।
১৯৩২-১৯৩৩, ১৯৪০, এবং ১৯৪২-১৯৪৩ সালে ব্রিটিশদের ক্ষমতাকালীন সময়ে তাঁকে কারাবাস গ্রহণ করতে হয়।
দূর্গাবাই দেশমুখ
১৯০৯ সালের ১৫ জুলাই রাজমন্ড্রিতে দূর্গাবাই দেশমুখ জন্মগ্রহণ করেন।
১২ বছর বয়সে তিনি কেসারি টি প্রাকাশাম এর সাথে অসহযোগ আন্দোলনের যোগ দেন। এর পাশাপাশি তিনি ১৯৩০ সালের মে মাসে মাদ্রাসে Salt সত্যাগ্রহ আন্দোলনেও অংশ নেন।
১৯৩৬ সালে দূর্গাবাই “আন্ধ্রা মহিলা সভা” প্রতিষ্ঠা করেন, যা এক দশকের মধ্যে মাদ্রাজ শহরে শিক্ষা ও সামাজিক কল্যাণে বিস্তর প্রভাব ফেলে। তিনি কেন্দ্রীয় সমাজ কল্যাণ বোর্ড, নারী শিক্ষা জাতীয় কাউন্সিল এবং গার্লস অ্যান্ড উইমেন এডুকেশন জাতীয় কমিটিসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এছাড়াও দূর্গাবাই দেশমুখ সংসদ সদস্য এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। নিউ দিল্লির “আন্ধ্রা এডুকেশনাল সোসাইটি” এর সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ভারতে শিক্ষার উন্নয়নে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৭১সালে দুর্গাবাইকে চতুর্থ নেহরু সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল ও ১৯৭৫ সালে তিনি পদ্মভূষণে ভূষিত হন।
আরো পড়ুনঃ
বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া নারীরা
ফাতিমা আলি জিন্নাহ
১৮৯৩ সালের ৩২ জানুয়ারি ফাতিমা আলি জিন্নাহ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে একজন ডেন্টাল সার্জন, বায়োগ্রাফার, স্টেটসওমেন এবং পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এছাড়াও তাঁর আরেকটি পরিচয় হল তিনি মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এর বোন।
ফাতিমা আলি জিন্নাহ সর্বদাই ছায়ার মত তার ভাইয়ের সাথে ছিলেন এবং নিরবে তাঁর কাজ করে গিয়েছেন। তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের মহিলা শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান তৈরীর পরে তিনি “ওমেন’স রিলিফ কমিটি” প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে “অল পাকিস্তান ওমেন’স এসোসিয়েশন” এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
উপমহাদেশের বিভাজনের পরে আগত শরনার্থীদের নতুন বসতি স্থাপনে তিনি সাহায্য করেন। ১৯৬৫ সালে ৭১ বছর বয়সে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং নির্বাচনে দাঁড়ান। তবে বিপুল জনপ্রিয় হয়েও তিনি নির্বাচনে জিততে পারেননি। ১৯৬৭ সালে করাচীতে নিজ বাসায় তিনি মারা যান।
বেনজির ভুট্টো
১৯৫৩ সালে জন্ম নেওয়া বেনজির ভুট্টো ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধান মন্ত্রী। হার্ভার্ড এবং ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পড়াশোনা করেন।
বেনজির তার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কালে ৩৫,০০০ ভূমিহীন চাষীদের মাঝে জমি বিতরন করেন। প্রতিটি শিল্প নগরীতে শ্রম উপনিবেশ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সারা দেশে ৮০,০০০ নতুন সাক্ষরতা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ছাত্র ইউনিয়নের উপর নিষেধাজ্ঞা উত্থাপিত করা হয়।
নারীদের জন্য বেনজির করাচি, লাহোর ও ইসলামাবাদে কম্পিউটার সেন্টার শুরু করা হয়। নারী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম নারী যিনি একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করেছিলেন।
তবে বেনজির ভুট্টো ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে তার ব্যাপারে নানা ধরনের দুর্নীতি এবং আরো অনেক বিতর্ক থাকলেও তিনি সবার কাছে পাকিস্থানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন।
ক্ষমতা হারিয়ে দীর্ঘদিন নির্বাসিত থাকার পর ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর নির্বাচন উপলক্ষ্যে দেশে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন বেনজির ভুট্টো।
মালালা ইউসুফজাই
পাকিস্তানের দ্বিতীয় নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের জন্ম ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই।
২০০৯ সালে ১১ বছর বয়সে মেয়েদের শিক্ষার জন্য প্রচারণা কার্যক্রম চালানোর কারণে তালেবান বন্দুকধারীদের আক্রমণের স্বীকার হয়েছিল মালালা। সুস্থ হয়ে উঠার পরে মালালা বার্মিংহামের মালালা ফান্ড নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
২০১২ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালের সাখরভ পুরস্কার পেয়েছিলেন। টাইম ম্যাগাজিন ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে তাকে বিশ্বব্যাপী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে প্রকাশ করে।
ভারত এবং পাকিস্তানের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা এই নারীদের তালিকায় যে নামটি বাদ পড়েছে, সেটি হল ইন্দিরা গান্ধী। তিনি শুধু যে ইতিহাসের গতিপথই ঘুরিয়ে দিয়েছলেন তা নয়, এই উপমহাদেশের মানচিত্র বদলে দেওয়াতেও রয়েছে তার অবদান। ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে সম্পূর্ণ একটি ফিচারই পড়ে আসতে পারেন এখানে:
ইন্দিরা গান্ধীঃ ভারতের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী
ভারতীয় উপমহাদেশ এইসকল নারী ব্যাক্তিত্বের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে যুগ যুগ ধরে, তাঁরাও আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবেন প্রথাগত অনাচার ভেঙ্গেচুরে ইতিহাস নতুন করে লেখার।
