আজ আমরা যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এতো উৎকণ্ঠার ভিতরে আছি, একবারও কি ভেবে দেখছি এর শুরুটা কোথায়, কিভাবে? এই পৃথিবীটা যেভাবে নিশ্চিহ্ন হবার সুযোগ খুঁজছে তার পিছনে শুধু কি এই বর্তমান আমরাই দায়ী? নাকি এর পিছনে রয়েছে আরো কোনো গল্প? যা একটু একটু করে আমাদের নিয়ে এসেছে বর্তমানের এই দূষিত পৃথিবীতে।
ছোটবেলা থেকে কমবেশি আমরা সবাই আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে কলম্বাসের নামের সাথে পরিচিত। প্রচলিত আছে ১৪৯২ সালের ১২ই অক্টোবর ক্রিস্টোফার কলম্বাস ( ইটালীয়ান নাম Cristoforo Colombo) নামের এক নাবিক অসীম সাহসীকতার সাথে আটলান্টিক মহাসাগরে অভিযান চালিয়েছিলেন এবং উত্তর আমেরিকার ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে নোঙ্গর ফেলেছিলেন। শত বছর ধরে এটাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। বর্তমানে এই নিয়ে নানারকম বিতর্ক উঠলেও এটা নিশ্চিত যে জলবায়ু পরিবর্তনের শুরুর গল্পটা এই এখানেই আছে। কলম্বাসকে বর্তমানে আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের হোতা এবং স্থানীয় আদিবাসীদের গনহত্যার অগ্রদূত হিসেবে দায়ী করা হয়। কারণ আমেরিকায় তার পা পড়ার পরেই আমেরিকা মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছিল যা সরাসরি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল জলবায়ুর উপর।
ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় প্রায় ১০০ বছর ধরে ৫৬ মিলিয়ন আদিবাসীদের হত্যা করেছিল। শুধু যে জমি দখলের জন্য যুদ্ধ কিংবা সরাসরি গণহত্যা – তা না, সাথে ছিল নীরব ঘাতক নানান মহামারী। যার ফলে উত্তর আমেরিকার কৃষিভূমির বড় একটা অংশ পরিত্যক্ত হয়েছিল। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) এর ভূগোল অধ্যাপক মার্ক মাসলিন বলেন,
“আদিবাসী আমেরিকানদের মৃত্যু ইউরোপীয় অর্থনীতির সাফল্যে সরাসরি অবদান রেখেছে”
আসলে আমেরিকা থেকে পাঠানো প্রাকৃতিক সম্পদ আর খাদ্য ইউরোপের জনসংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এতে ইউরোপিয়ানরা লাভবান হলেও আমেরিকান আদিবাসীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
ইউরোপিয়ানরা আমেরিকা আসার পর মহামারী শুরু হয়। আমেরিকার অধিবাসীদের এই মহামারীর কারন ছিল অজানা রোগের জীবাণু। এই মহামারীর মূলে ছিলো ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারী আর আফ্রিকান ক্রীতদাসরা, যাদের মাধ্যমে এটা আমেরিকার আদিবাসীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব রোগ আদিবাসী আমেরিকানদের কাছে অজানা থাকায় এর প্রতিকারের কোন উপায়ও ছিল না তাদের কাছে। তাছাড়া তাদের শরীরও এসব রোগ প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই রোগগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল গুটিবসন্ত, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা, বুবোনিক প্লেগ, ম্যালেরিয়া, ডিপথেরিয়া, কলেরা। এগুলো মূলত ইউরোপ থেকে আসা খামারের পশুর মাধ্যমে ছড়াতো। আর খুব কমসংখ্যক ছড়াতো গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে। এভাবেই আমেরিকা পরিচিত হয়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, গুটিবসন্ত, বুবনিক প্লেগের সাথে। প্রাথমিকভাবে এই রোগগুলো এককভাবে প্রায় ৩০% বা তার চেয়ে বেশি মানুষকে মেরে ফেলেছিল।
ইতিহাসের অন্যান্য মহামারীর চেয়ে এখানে প্রায় ৯৫% মৃত্যুর হার বেশি ছিল। অন্যান্য মহামারী গুলো শুধুমাত্র একটা রোগের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং এক দশকের কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। কিন্তু এই Virgin Soil Epidemics প্রায় ৫০ বছর ধরে আমেরিকায় শেকড় গড়ে বসেছিল। এসময় যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে বেঁচে গেছিলো তারা হয়তোবা পরে গুটিবসন্ততে আক্রান্ত হয়েছিল। অথবা কেউ এ দুটো থেকে বেঁচে গেলেও পরে কলেরাতে মরেছে। এইভাবে প্রায় আটটা রোগে (গুটিবসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্কারলেট ফিভার, হাম, টাইফাস, নিউমোনিয়া, ইয়োলো ফিভার) প্রায় ৯৫% মানুষ মরে যায়।
ইউরোপিয়ানরা আগমনের পরে জনসংখ্যা হ্রাস এবং মাথাপিছু ভূমি ব্যবহার কমে যাবার কারণে বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যার ফলে আমেরিকাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন হ্রাস পায়। ১৫০০ শতকের পুরোভাগে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর পরে ৫৬ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি পরিত্যক্ত হয়ে যায়, যে জায়গাটি পরিণত হয় বনভূমিতে। একইসাথে বিপুল পরিমাণে মানুষ মারা পড়ায় যেমন হঠাৎ করে কার্বন নিঃসরণ কমে যায়, একই সাথে বনভূমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের মত গ্রিনহাউজ গ্যাস শোষণের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল।
আর আচমকা এই নাটকীয় পরিবর্তনের হাত ধরেই সূচনা হয় লিটল আইস এজ এর। লিটল আইস এজ (Little Ice Age) হচ্ছে মধ্যযুগীয় উষ্ণ পর্বের পরে আসা শীতলতার একটি সময়। অনেক দ্বিমত থাকলেও প্রচলিতভাবে ১৪ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত সময়কে লিটল আইস এজ বলা হয়। লিটল আইস এজ ইউরোপ এবং উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে প্রভাবগুলির জন্য সর্বাধিক পরিচিত। লিটল আইস এজ ইউরোপ এবং উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে প্রভাবগুলির জন্য সর্বাধিক পরিচিত। এই সময় আল্পস পর্বতমালায় হিমবাহ বেড়ে গেছিলো। জলবায়ুর বিরুপ পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল যা মধ্য ইউরোপের বেশিরভাগ স্থানে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে।
কলম্বাস যদি ভূল করে আমেরিকার মাটিতে পা না রাখতো তাহলে হয়তোবা এই ৫৬ মিলিয়ন মানুষ মরতো না। আর জলবায়ুর এই ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন ও ঘটতো না।
প্রকৃতি আপনা আপনি কিছু করে না। কিন্তু আমাদের করা সব কর্মকান্ডই তাকে বিরূপ হতে বাধ্য করে আমাদের উপর। প্রায় কয়েকশত বছর আগের করা মানুষের কর্মকাণ্ড কিভাবে জলবায়ুর উপরে প্রভাব ফেলেছিল তা এখন আমরা বুঝতে পারছি। আমাদের পূর্বপুরুষদের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়াড় সুযোগ পাচ্ছি। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে প্রকৃতি নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে নানান প্রজাতি। খামখেয়ালিভাবে পরিবেশ এবং এই পৃথিবীর উপর ছড়ি ঘুরিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কতদিন পারবে মানব সম্প্রদায়- এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন!
