আমাকে কেউ যদি কখনো জিজ্ঞেস করে দেশের সবচাইতে সুন্দর জায়গা কোনটা। আমি মনে হয় চোখ বন্ধ করে বলবো সেটা হল পার্বত্য চট্টগ্রাম; বিশেষত বান্দরবান। তিনটা পার্বত্য জেলার মধ্যে ট্যুরিস্টরা যেসব জায়গা যায় বা যেতে পারে তার বেশিরভাগটাই এ জেলাতে। বান্দরবানের মূল শহর থেকে তিনটি উপজেলাতে যাওয়া যায়, রুমা- থানচি আর রোয়াংছড়ি। কেওক্রাডং, তাজিনডং বা হাল আমলের ক্রেজ নাফাখুম-আমিয়াখুম সবই এ তিনটি উপজেলায়। কিন্তু ইদানিং নিরাপত্তাজনিত বহুত হাবিজিাবি ব্যাপারের জন্য ওসবদিকে যাওয়াটা রীতিমতো বিরক্তিকর হয়ে পড়েছে। কিন্তু যারা ঘোরাঘুরি করে তাদের জন্য নতুন লোকেশন বের করা কঠিন কিছু না। এবারে আমদের গন্তব্য বান্দরবানের সবচাইতে unexplored উপজেলাগুলোর একটা, আলিকদম।
ট্যুরের প্ল্যান খুব সিম্পল। আমরা যাবো আলিকদমের এক পাহাড়চুড়ায়। ওখানেই রাত থাকবো। এ জায়গাটা যারা ক্যাম্প করে থাকতে চায় তাদের জন্য এককথায় অসাধারণ। এখন হলো ট্যুরমেট জোগাড় করার কাজ। আমার যাদের সাথে যাবার কথা ছিলো এক সপ্তাহ আগেই কিন্তু বিশেষ কারণে যেতে পারি নি। তবে ঘোরাঘুরির জন্য পোলাপানের অভাব কোনকালেই হয়নি! বন্ধু অনুপ আসবে ঢাকা থেকে, আর চিটাগং থেকে আমি, ভায়রাভাই-কাম-বন্ধু দেবু, আর ওর দুজন কলিগ যাবে। এ ধরণের ট্যুরে খুব বেশি লোকজন অপ্রয়োজনীয়! প্ল্যান হলো সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ যাবো আমরা। অনুপ আগের রাতে সরাসরি চকরিয়া চলে আসবে বাকি আমরা চিটাগং থেকে পরদিন দেখা হবে।
২৮ তারিখ সকালে ৬ টার সময় ফোনের যন্ত্রণায় ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে গেছিলাম। অনুপ সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে কারণ সে অলরেডি আলিকদম পৌঁছে গেছে। আমরা এখনো রওনাই হতে পারি নাই। দেবুরে বললাম তাড়াতাড়ি বের হতে, সে আমার বাসার নিচে চলে এসে ফোন দিচ্ছে। ছোটভাই গতবার আমেরিকা থেকে আসার সময় টেন্ট নিয়ে এসেছে গিফট হিসেবে। ওটা নিয়ে নিচে নেমে দেখি দেবু’র দুজন কলিগের একজন এসছে। ট্যুরে এসব ঘটেই। আগের রাতে নাকি তারও আসার প্ল্যান বাতিল হয়ে গেছিলো, কিন্তু কি ভেবে সকালে চলে এসেছে। সে যাই হোক আমরা তিনজন কর্নফুলি ব্রীজের গোড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল ৮ টা বাজে। কক্সবাজারের বাসে ওঠার আগে তিনজন বসে চা খেতে খেতে কথা বলছিলাম। দেবুর সাথে অনেকদিন পর ট্যুরে যাচ্ছি আর ওর কলিগ (নাম হলো রাজ), খুবই মজার একটা ছেলে। আমার অনেকদিনের ঘোরাঘুরির একটা অভিজ্ঞতা হলো প্রতিবার নতুন কোন সদস্য থাকে। একই রকম গ্রুপ দুটো ট্রিপ করেছি এমন কখনো হয়নি।
চকরিয়া পৌঁছতে বেলা ১২ টা। এখন চাঁদের গাড়ি তথা জিপে যাবো আলিকদম। তবে চান্দের গাড়ি পাইনি। আমরা পেয়েছিলাম মাইক্রোবাস। রওনা হতে হতে দুপুর একটা বাজে। অনুপের ফোনের যন্ত্রণায় মাথা নস্ট অবস্থা! চকরিয়া থেকে আলিকদম যাবার রাস্তাটা এককথায় অসাধারণ সুন্দর। খুব বেশি উঁচু-নিচু না। মাঝে একজায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়েছে। চা খেতে খেতে নিচের দিকে তাকাচ্ছি। বেশ খানিকটা উপরে উঠেছি মনে হচ্ছে। মনে কেমন যেনো একটা উত্তেজনা বোধ করছি! অনেকদিন পরে পাহাড়ে যাচ্ছি, তাও ক্যাম্পিং-এ। নতুন জায়গা দেখার মধ্যে অদ্ভুত মজা আছে এটা বোধকরি মানুষের একদম মজ্জাগত একটা ব্যাপার!
আলিকদম যাবার অল্প কিছুটা আগে আবাসিক নামে একটা জায়গা আছে। ওখানেই নামতে হবে। আমারা দূর থেকে দেখছি অনুপ বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উপরে! ৭ ঘন্টা এমন আকাইম্মা জায়গাতে বসে থাকার জন্য মানসিকভাবে কতটা শক্ত হতে হয় সেটা অনুপকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছি! আমরা নামার সাথে সাথে অনুপ মনে হয় বুকে একটু প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এটা একটা ছোটখাটো ধরনের বাজার। সে একটা কাজের কাজ করেছে (তবে সত্যিকার অকাজের) । রাতে খাবার জন্য নুডলস, বিস্কিট, পানি এসব নিয়ে রেখেছে; রাতে আগুন জ্বালানোর জন্য পেনস্টোভ নিয়ে এসেছে। এখন কেরোসিন নিতে হবে। শুক্রবার দুপুর সময়। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। এক দোকানদারকে ফোন করে কেরোসিন নেয়া হলো। এখন রওনা দিবো। দুপুরে একটু খাওয়াদাওয়া করবো কিন্তু অনুপের বিরক্তি দেখে আর সাহস হয়নি বলার! ওর মতে নাকি একবেলা না খেলে তেমন কোন ক্ষতি হবে না! তবে ক্ষিদাও অতো নেই মাঝেআমাদের কলা, বিস্কিট, চা অনেক পরিমানে খাওয়া হয়েছে।
আবাসিক এলাকা থেকে ডানদিকে কিছুটা সমতল পথ হেঁটে পাহাড়ের একদম নিচে পৌঁছে গেছি। যাবার সময় বেশ কিছু পাহাড়ি পরিবার। এখানে ওঠার সবচাইতে কঠিন ব্যাপারটা হলো সবকিছু নিচ থেকে নিয়ে উঠতে হয়। মাঝে কিছু পাওয়া যাবেনা আমরা মোট ১০ লিটার পানি নিয়েছি। একরাতের জন্য মনে হয়েছে যথেষ্ঠ (কিন্তু আদতে তা ছিলো না)। নিচ থেকে ওঠা শুরু করেছি আমরা। দেবু হলো আমাদের মধ্যে প্রফেশনাল ট্রেকার। সে এতোবেশি পাহাড়ে এসেছে যে আমরা বলি অনেকটা ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে পাহাড়ে আসার মতন ব্যাপার। তার লক্ষ্য অবশ্য হিমালয়ের সাদা পাহাড় জয়করা, ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েকটা হিমালয়ের পিক সামিট ও করে এসেছে। অনুপের কথা যদি বলি সে-ও বেশ ভালো ট্রেকার। অন্নপূর্না বেস ক্যাম্পে দেবুদের সাথে ছিলো। সেগুলো অনেক বিশাল কাহিনী! অনুপ নিজেকে অবশ্য প্রফেশনাল ট্রেকার হিসেবে পরিচয় দিতে চায়, আমরা সে স্বীকৃতি কখনোই দেইনা তাকে! আর এখানে দেবু অনেকবছর আগে এসেছে, অনুপ কিছুদিন আগেই এই জায়গায় ক্যাম্প করেছে। তাই বাই ডিফল্ট আমাদের গাইড হিসেবে আছে! সে তুলনায় আমি মূলত ট্রেকার না… ট্যুরিস্ট বলা যেতে পারে। সময়ের অভাবে আমি অনেকগুলো জায়গাতেই যেতে পারিনা। রাজ ছেলেটা বলতে গেলে একেবারেই এ লাইনে নতুন! সে মনে হয় দ্বিতীয়বারের মতন এসেছে পাহাড়ে। তবে ছেলেটার একটা জিনিস বেশি ভালো লেগেছে, সে আমার মতোন পুরোপুরি লেভেলের চা-পাগল। আমরা চান্স পেলেই কোন জায়গায় চা খাওয়ার জন্য বসে যাই।
উপরে উঠার ১০ মিনিট পরেই আমি পুরা টায়ার্ড ফিল করছিলাম! ব্যাগে টেন্ট আর ৪ লিটার পানি। কাপড়-চোপড় তেমন নাই। তাপরেও বেশ ভারি বোধ হচ্ছে। আর পথটা যে কিরকম! মানে মনে হচ্ছে একটানে উঠে গেছে উপরে।
স্লোপ হিসেবে বলতে গেলে ৭০ ডিগ্রী মতন খাড়া। প্রথম অংশটা হেরিংবোনইটের রাস্তা। এর মাঝে দু’লিটার পানি একাই খেয়ে ফেলছি আমি। শরীর আরো ভারি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। দেবুর ব্যাগ বলতে কিছু নাই, ও একটা টিশার্ট আর শর্টপ্যান্ট পরে চলে এসেছে। কিছুদূর ওঠার পরে ওকে দিয়ে দিয়েছি আমার ব্যাকপ্যাক। তারপরেও ৭৫ কেজি ওজনের শরীর নিয়ে উপরে উঠার হ্যাঁপা পোহাচ্ছি! পাহাড়ের একটা ব্যাপার বুঝিনা, এগুলো কি কারণে এতো খাড়া হয়ে থাকে, স্লোপ একটু কম হলে কত আরাম করে যাওয়া যেতো ওটা ভাবি। অনুপের শরীরে মনে আজরাইল টাইপ কিছু ভর করেছে, ওর ব্যাগও কম ভারি না। সেটা নিয়ে বাই-বাই করে উপরে উঠে যাচ্ছে আর কতদূর ওঠার পরে উপর থেকে হাত দেখায়! বয়স বাড়লে এনার্জি নাকি কমে, তার ক্ষেত্রে এরকম কিছু ঘটেনি বোঝাই যায়। রাজ ছেলেটাও মোটামুটি উঠে যাচ্ছে, আমি সবার পেছনে ধীরে ধীরে উঠছি।
অর্ধেকটা পথ উঠে এসেছি। এ রাস্তাটায় কোন নামানামির ব্যাপার-স্যাপার নাই। শুধু উপরে ওঠো। মাঝে একটা পাহাড়ি পাড়া পড়েছে। রাস্তার পাশে কি সুন্দর জাম্বুরা ঝুলে আছে। চাইলে মনে হয় নেয়া যাবে। আমরা ওগুলোর দিকে নজর না দিয়ে উপরে উঠছি। একটা সুন্দর বসার মতন জায়গা পেলাম বিশাল গাছের নিচে। ওখান থেকে নিচের পাহাড়, দূরে মাতামুহরী নদী… আহা কি সুন্দর লাগছে। আরো উপরে উঠতে হবে এটা ভাবতেই মন খারাপ হচ্ছিলো।
হঠাৎ দেখি উপর থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক নামছেন। বয়স ৮৫ বা ৯০ বা তারও বেশি। কাঁধে জাম্বুরা’র এক বিশাল খাঁচা। উনি কি সুন্দর রিদমিক ভাবে নেমে যাচ্ছে, আহা! উনাকে ডাক দিলাম। নাম জিজ্ঞেস করলাম, উনি কি যে উত্তর দিলেন কিছু না বুঝে বললাম আসেন ছবি তুলি। বয়সে উনি দাদুর সমান। একটু মজা করাই যায়! উনি ছবি তোলার পরে ব্যাপক খুশি হয়ে গেছে। তবে আমার একটা কাজ হয়েছে। উনাকে দেখে মেন্টাল এনার্জিটা বেড়ে গেছে। এতো বয়স্ক মানুষ যেতে পারলে আমাদের না যাবার কোন কারণই নাই। আমরা তো উনার হাঁটুর বয়েসি! কি আছে জীবনে এই ভাবতে ভাবতে আবার ওঠা শুরু করেছি। পাহাড়ে ওঠা বা যেকোন কঠিন কাজ করার মূল চ্যালেন্জটা হলো সত্যিকার ভাবে মানসিক।
পরবর্তী পর্বঃ পাহাড়চুড়ায় ক্যাম্পিং, মারাইনথং, আলীকদম- দ্বিতীয় পর্ব
লিখেছেনঃ প্রণব রায় চৌধুরী
