মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। গল্পের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জীবনের অভিজ্ঞতার আদান প্রদান হয়। এককালে মানুষ মুখে গল্প বলত, আর এখন বলে সিনেমার মাধ্যমে। তাকে আবেগমথিত করা চরিত্র অথবা চমৎকার অভিনয়; অভিভূত করা এডিটিং; ক্যামেরার অসাধারণ কাজ; মনোমুগ্ধকর স্পেশাল ইফেক্ট। আর সিনেমায় গল্প যেহেতু দৃশ্যরূপে উপস্থাপিত, তাই গল্পের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখানো সেখানে খুব সম্ভব। মানুষকে এ স্বপ্ন দেখাতে পারা পরিচালকের সংখ্যা কিন্তু হাতে গোনা। আর এদের মধ্যে অন্যতম স্ট্যানলি কুবরিক। চলচ্চিত্র প্রেমীদের জন্য এই পৃথিবীকে আরো সুন্দর করার পিছনে তার অবদান কখনো অস্বীকার করা যাবে না।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের ন্যূনতম খোঁজ খবর যারা রাখেন তারা অবগত আছেন, চলচ্চিত্রের বিশাল ভুবনজুড়ে স্ট্যানলি কুবরিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণের দিক থেকে, কারিগরি দিক থেকে, কিংবা চলচ্চিত্রের শৈল্পিক অবস্থান তৈরিতে কুবরিক কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা অনুধাবন করা যায়। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে কুবরিকের ছোঁয়ায় বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎকর্ষতার দিক থেকে হলিউডের ছবিগুলোকে পৌঁছে দিয়েছেন অন্য উচ্চতায়।
বিখ্যাত এই মার্কিন চলচ্চিত্রকার ১৯২৮ সালের ২৬ জুলাই ম্যানহাটনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক ও আলোকচিত্রী। স্ট্যানলি কুবরিক শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে বেশ কয়েকবার অস্কারের জন্য মনোনীত হন। ১৯৯৬ সালে তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘২০০১: এ স্পেস অডিসি’ ভিজুয়াল ইফেক্ট বিভাগে অস্কার জেতে। এছাড়াও তার কয়েকটি ছবি বিভিন্ন সময় নানা বিভাগে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়। তাকে চলচ্চিত্র ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল ও প্রভাবশালী নির্মাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। কুবরিকের চলচ্চিত্রের অধিকাংশই বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যকর্মের চিত্ররূপ।
কুবরিক সুদীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে মাত্র ১৬টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার প্রায় সবগুলো সিনেমাই বিশ্ব চলচ্চিত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। তার সিনেমা ক্যারিয়ারের মূল বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্য; বিভিন্ন ধরনের ছবি বানিয়েছেন তিনি।
সিনেমা বিষয়ে স্ট্যানলি কুবরিক এর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ১৩ বছর বয়সে কুবরিক বাবার কাছ থেকে একটি ক্যামেরা পেয়েছিলেন। ক্যামেরা হাতে ছবি তুলে বেড়ানো সে সময় তার অন্যতম শখ ছিল। এছাড়া কৈশোরে জ্যাজ সংগীতের প্রতি আসক্ত ছিলেন তিনি।
কুবরিক একাডেমিক পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিলেন না। ১৯৪৫ সালে হাইস্কুল পাস করার পর উচ্চশিক্ষা নিতে চেয়েছিলেন। হাই স্কুল শিক্ষা যখন শেষ করেন তখন আমেরিকায় মন্দা চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সেই দেশে নিয়ম করা হয়েছিল, ৬৭% এর উপর নম্বর না থাকলে কেউ কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। তাই হাই স্কুলের পর আর কুবরিকের পড়াশোনা করা হয় নি। সব মিলিয়ে তাই আর উচ্চশিক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি তার। পরবর্তীতে মন্তব্য করেছিলেন যে, স্কুল তাকে কিছুই শেখাতে পারেনি, এমনকি স্কুলের কোনকিছুতে তিনি কোনদিন উৎসাহও পাননি।
ছোটবেলা থেকে শখ ছিল ছবি তোলা, ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়ানোটা তার জন্য একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনা থেকে মুক্তি পেয়ে তাই বেরিয়ে পড়েন ক্যামেরা হাতে। শুরু হয় কুবরিকের ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফি জীবন। সমাজ-বাস্তবতার শৈল্পিক রূপায়ন তার এই জীবনকে বেশ সার্থক করে তোলে, অচিরেই সেকালের বিখ্যাত ‘লুক’ ম্যাগাজিনের নজরে পড়ে যান। লুক এর জন্য তিনি পরবর্তীতে প্রায় ৫-৬ হাজার ছবি তুলেছিলেন। এই ফটোগ্রাফি জীবনই তাকে সিনেমা বানাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। লুক এর পর তার পৃষ্ঠপোষক হয়েছে হলিউডের স্টুডিওগুলো।
১৯৫১ সালে ‘ফ্লায়িং পাদ্রে’ নামের একটি ডকুফিল্ম নির্মাণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে হাতেখড়ি স্ট্যানলি কুবরিকের। এরপর ‘ফেয়ার এন্ড ডিজায়ার’ নামের অসাধারণ এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। মাত্র ৬২ মিনিটের ওই ছবি দিয়ে ফিচার ফিল্মের জগতে প্রবেশ তার। একে একে নির্মাণ করেন কিলার’স কিস, দ্য কিলিং, পাথস অব গ্লোরি, স্পার্টাকাসের মত অসাধারণ সব সিনেমা। ১৯৬২ সালে কুবরিক নির্মাণ করেন ‘লোলিতা’ নামের ছবি, যা হাস্যরসের মধ্য দিয়ে এক অসাধারণ রোমান্টিক আখ্যানের গল্প পরিবেশিত হয়। তবে স্ট্যানলি কুবরিক নাম নিলেই যে ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে, তা হচ্ছে ‘২০০১: অ্যা স্পেস ওডিসি’, ‘অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ এবং ‘দ্য শাইনিং’। দ্য শাইনিং নির্মাণ নির্মাণ করেন ১৯৮০ সালে। এরপর দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৮৭ সালে কুবরিক নির্মাণ করেন ‘ফুল মেটাল জ্যাকেট’ এবং তারও একযুগ পরে কুবরিক নির্মাণ করেছেন তার শেষ ছবি ‘আইস ওয়াইড শাট’।
কুবরিক পুরো সময় জুড়ে একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন, অনেকে তাকে পৃথিবীর প্রথম ‘স্বাধীন চলচ্চিত্রকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। তার সিনেমায় স্টুডিওর বলার কিছু ছিল না, অর্থ যোগান দেয়া ছাড়া তাদের আর কোন কাজ ছিল না।
এ কারণেই কুবরিকের সিনেমায় সমাজ-সচেতনতা এবং সভ্যতার অবক্ষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। আধুনিক জনপ্রিয় শিল্প এবং সংস্কৃতিকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি, এগুলোকে অবক্ষয়ের চিহ্ন হিসেবে দেখেছেন। সিনেমার মাধ্যমে এর মর্মমূলে আঘাত করতে চেয়েছেন। বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকরা সাধারণত মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম কুবরিক, যিনি মনোবিজ্ঞানের বদলে বেছে নিয়েছিলেন সমাজবিজ্ঞান। কোন সিনেমার থিম মাথায় আসার পর কুবরিক গবেষণায় লেগে যেতেন। সিনেমা বানাতে প্রায় ৪-৫ বছর লাগতো, গবেষণার জন্যই বরাদ্দ থাকতো একটা বড় সময়।
নির্মাণের দিক থেকে তিনি এতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন যে, তার করা প্রায় সকল সিনেমারই কাজ তিনি নিজে তদারকি করতেন। ক্যামেরা চালানো থেকে শুরু করে একেবারে নির্দেশনা পর্যন্ত সব কাজ তিনি একাই সামলাতেন। মনপুত না হলে তিনি পুনরায় কাজটি করতেন। মানে প্রি-প্রোডাকশন থেকে একেবারে পোস্ট-প্রোডাকশন পর্যন্ত সব কাজই একা একা সামলাতেন কুবরিক। কাজের বিষয়ে কোনো ধরণের ছাড় পছন্দ করতেন না তিনি।
শুধু তাই না, নিজের কাজের মধ্যে অন্যের হস্তক্ষেপও দারুণভাবে অপছন্দ করতেন তিনি। তাই ১৯৬০ সালে যখন তার অন্যতম চলচ্চিত্র ‘স্পার্টাকাস’ নির্মাণ করলেন, তখন প্রযোজক ফোরামের হস্তক্ষেপ তাকে বিষিয়ে দিয়েছিল। তিনি কোনভাবেই এগুলো বরদাস্ত করতেন না, কিন্তু স্পার্টাকাসে প্রযোজকদের কথা শুনলেন এবং তা শেষবারের মত। এরপর তিনি ঘোষণা্ দিলেন যে, তাকে দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করলে লগ্নিকারদের কিংবা কারো কোনো আবদার, অনুরোধ রক্ষা করতে পারবেন না। এরপর থেকে যতোদিন বেঁচে ছিলেন, এবং সিনেমা নির্মাণ করে গেছেন; তার সিনেমায় কারো কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেননি। একেবারে স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন কুবরিক।
টেকনোলজির ব্যবহারেও তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বর্তমান ছবিগুলোতে যে ‘ক্লোজ শট’ আমরা দেখি, তার আবিষ্কারক স্ট্যানলি কুবরিক। এছাড়াও নানা ধরণের শট নিয়ে বিস্তর নিরীক্ষামূলক কাজ তিনি করেছেন। শুধু টেকনিক্যালি কিংবা মেকিং বিষয়ে নয়; চিত্রনাট্য, গল্প বলার ধরণ, গল্পের বিষয়বস্তু সবকিছুতেই তিনি নতুনত্ব দিয়েছেন। এইজন্যই তার ১৬টি চলচ্চিত্রই বিষয়বৈচিত্রে ভরপুর।
গত ২৬ জুলাই ছিল বিশ্ববিখ্যাত এই পরিচালকের ৯০তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন ‘স্ট্যানলি কুবরিক’।
আরো পড়ুনঃ হলিউডের জীবন্ত কিংবদন্তী স্টিভেন স্পিলবার্গ
[আপনি কি একজন মুভিপাগল? আপনার প্রিয় পরিচালক/অভিনেতা/চলচ্চিত্র নিয়ে রিভিউ শেয়ার করুন সবার সাথে! আপনার লেখা মৌলিক রিভিউ কিংবা আলোচনা পাঠিয়ে দিন neonaloymag@gmail.com ঠিকানায়, আমরা সেই রিভিউ পৌঁছে দিব আপনার মত আরো হাজারো মুভিপাগলের কাছে।]
