মেধার বিকাশের আদিলগ্ন থেকেই মানুষ নানা কিছু উদ্ভাবন করে আসছে। থমাস আলভা এডিসন কিংবা গ্রাহাম বেল এর মত অজস্র গুনী বিজ্ঞানী তাদের অসংখ্য আবিষ্কার এর মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে ঋণী করে গেছেন। উদ্ভাবন এর পেছনে ইন্ধন জোগায় প্রয়োজন। তাই বলা হয়ে থাকে, “প্রয়োজনই উদ্ভাবন এর প্রসূতি”। এ কথা সত্য যে গুনীরা তাদের কর্মের মাঝে বেঁচে থাকেন। কিন্তু, প্রিয় সৃষ্টিই জীবননাশের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে এমন ঘটনাও পৃথিবীতে বিরল নয়।
চলুন জেনে নেয়া যাক এমন দশজন বিজ্ঞানীর কথা যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদেরই উদ্ভাবন এর হাতে যেগুলো তাদের বেশি আলোচিত করে তুলেছেঃ
১) ম্যাক্স ভ্যালিয়ের
( ৯ই ফেব্রুয়রি, ১৮৯৫ – ১৭ই মে, ১৯৩০)

ম্যাক্স ভ্যালিয়ের
তিনি সেসকল মানুষদের একজন যারা রকেটবিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তার গড়ে তোলা “স্পেসফ্লাইট সোসাইটি” বিংশ শতাব্দীর মানুষদের মহাকাশ ভ্রমনে প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯২৮-১৯২৯ সালে তিনি ও তার সংঘ রকেটচালিত গাড়িতে তরল জ্বালানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন।
দুটি সফল পরীক্ষার পর তৃতীয়বারের মতো তিনি কোনরকম সতর্কতা ছাড়াই একটি কম্বাসচন চেম্বারের সামনে বসে জ্বালানি হিসেবে কেরোকিন মিশ্রিত পানি আর অক্সিজেন এর মিশ্রনের ক্ষমতা পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ তার উদ্ভাবন এ বিস্ফোরণ ঘটে এবং ১৯৩০ সালের ৩০শে মে ৩৫ বছর বয়সে তার জীবনাবসান ঘটে।
২) লি সি
( ২৮০ পূর্বাব্দ – ২০৮ পূর্বাব্দ )

লি সি
লি সি চীনা ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি একাধারে ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ, আইনী লেখক এবং খোশনবিশ। ‘কিন’ রাজবংশের একজন উপদেষ্টা মতান্তরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
মানুষটি বিখ্যাত হয়েছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে। অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ৫টি উপায় প্রস্তাব করে তিনি সেগুলো নিজের ওপর প্রয়োগ করেছিলেন। উপায়গুলো হলোঃ মুখের চামড়া তুলে নেয়া, নাক কেটে ফেলা, ‘নী-ক্যাপ’ অপসারণ, জননাঙ্গ অপসারণ এবং অবশেষে, দেহ থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্নকরণ অথবা জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা। ফলাফলঃ স্মরণীয় মৃত্যু।
৩) ফ্রান্সিস এডগার স্টেনলি
( ১লা জানুয়ারি, ১৮৪৯ – ১৩ই জুলাই, ১৯১৮)

ফ্রান্সিস এডগার স্টেনলি
ফ্রান্সিস এডগার স্টেনলি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ব্যবসায়ী। তিনি ও তার জমজ ভাই ফ্রীল্যান ও. স্টেনলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘স্টেনলি মটর ক্যারিজ কোম্পানি’ নামের একটি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। অটোমোবাইল ব্যবসা শুরু করার আগে তারা ইংল্যান্ডে ফটোগ্রাফী স্টুডিও চালু করেন এবং পরবর্তীতে তা “ইস্টম্যান কোডেক” এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ইস্টম্যানের কাছে বিক্রি করে দেন।
১৯১৮ সালের ১৩ই জুলাই, ফ্রান্সিস মৃত্যুবরণ করেছিলেন তারই প্রতিষ্ঠান নির্মিত বাস্প-ইঞ্জিনচালিত একটি গাড়ি দুর্ঘটনায়। পাশাপাশি চলতে থাকা একটি মালগাড়িকে এড়াতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৪) জীন ফ্রাঙ্কইস পিলাত্রে দে রোজিয়ের
(৩০শে মার্চ, ১৭৫৪ – ১৫ই জুন, ১৭৮৫)

জীন ফ্রাঙ্কইস পিলাত্রে দে রোজিয়ের
এই ফ্রেঞ্চ ব্যক্তি ছিলেন একজন ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি শিক্ষক। ১৭৮৫ সালের ১৫ই জুন তিনি পিয়েরে রোমেইন কে সাথে নিয়ে নিজের তৈরি রোজিয়ের বেলুনে করে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিচ্ছিলেন। কিন্তু, বিধি বাম। বেলুনটি পাস দে ক্যালাইস এলাকায় আছড়ে পড়ে এবং তৎক্ষণাৎ উদ্ভাবকের মৃত্যু ঘটে। এটাই হয়ত উড্ডয়নে ত্রুটিজনিত কারণে ইতিহাসের প্রথম হতাহতের ঘটনা। রোজিয়ের এর হাইব্রিড বেলুনটির উড্ডয়ন এর জন্য ভিন্ন ভিন্ন চেম্বারে একই সাথে উষ্ণ ও শীতল বায়ু ব্যবহার করা যেত।
৫) ফ্রান্জ রেইচেল্ট
(১৮৭৯ – ৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯১২)

হাতে বোনা প্যারাসুট পরিহিত ফ্রান্জ রেইচেল্ট
“উড়ন্ত দর্জি” নামে খ্যাত ফ্রেঞ্চ এই ব্যক্তি দাবি করেছিলেন তার হাতে তৈরি প্যারাসুট সফল উড্ডয়নে সক্ষম। জনসম্মুখে পরীক্ষার জন্য তিনি নিজের তৈরি প্যারাসুট নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্যারিসে অবস্থিত বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার এর শীর্ষে। প্রথম পরীক্ষার খাতিরে ডামি ব্যবহার করা হবে বলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে শেষমেশ নিজেই ঝাপিয়ে পড়েন কিন্তু শেষরক্ষা আর হয় নি। ত্রুটিপূর্ণ প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়া কাল হয়ে দাঁড়ায় রেইচেল্টের জন্যে।
৬) হেনরি স্মলিনস্কি
(১৩ই মে, ১৯৩৩ – সেপটেম্বর ১৯৭৩)
হেনরি তার নিজের গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান “অ্যাডভানসড ভেহিকেল ইঞ্জিনিয়ার্স” কর্তৃক নির্মিত ‘ফর্ড পিন্টো’ নামে পরিচিত এ.ভি.ই মিজার গাড়িটিতে চেসনা ৩৩৭ বিমানের পাখা লাগিয়ে উড়ন্ত গাড়ি তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তার বন্ধু হ্যারল্ড ব্লেক কে সাথে নিয়ে উড্ডয়নে সক্ষমও হয়েছিলেন। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী তার ‘পিন্টো ক্রাফট’ গাছের শীর্ষে ধাক্কা লেগে একটি ট্রাকের ওপর আছড়ে পড়ে এবং পরক্ষণেই বিস্ফোরিত হয়। নিজের উদ্ভাবন করা গাড়ির ভেতরেই হেনরির মৃত্যু ঘটে। একই সাথে ‘মিজার’ গাড়িটি বিখ্যাত “বন্ড” মুভিতে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ হারায়।
৭) উইলিয়াম বুলক
(১৮১৩ –১২ই এপ্রিল, ১৮৬৭)

উইলিয়াম বুলক
আমেরিকার এই ব্যক্তি ছিলেন রোটারি প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কর্তা। ১৮৬৩ সালে তার এই আবিষ্কার তৎকালীন সময়ে বিপ্লব বয়ে এনেছিল। তার এই সৃষ্টি কিভাবে তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে তা সহজে আন্দাজ করা যায় না।
আবিষ্কারের কিছুদিন পর তিনি তার যন্ত্রে খুঁটিনাটি সংযোজন বিয়োজন করছিলেন। এ সময় একটি পুলি তে লাথি দিলে তার পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ধীরে ধীরে তার ক্ষত পঁচে যেতে শুরু করে। পরে তার পা কেটে ফেলার সময় তার মৃত্যু ঘটে।
৮) হোরেস লসন হানলে
(২০শে জুন, ১৮২৩ – ১৫ই অক্টোবর, ১৮৬৩)

হোরেস লসন হানলে(বামে) এবং তার নির্মিত ডুবজাহাজ(ডানে)
হানলে ছিলেন তৎকালীন আমেরিকার একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি প্রথম হাতে চালিত সামরিক ডুবোজাহাজ তৈরি করেন। তার তৈরি প্রথম জাহাজটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ৫ জন ক্রু জীবন হারায়। পরবর্তীতে, ১৮৬৩ সালের ১৫ই অক্টোবর তিনি তার সাবমেরিনটি মেরামত করে আবার পরীক্ষা চালান। এবারও ডুবোজাহাজটি দূর্ভাগ্যের শিকার হয় এবং হানলেতার ৭জন ক্রুসহ মৃত্যুবরণ করেন।
৯) মেরী কুরি
(৭ই নভেম্বর, ১৮৬৭ – ৪ই জুলাই, ১৯৩৪)

বিজ্ঞানাগারে মেরী কুরি
তিনি মাদাম কুরি নামেই অধিক পরিচিত। ইতিহাসে প্রথম দুবার নোবেলজয়ী এই পোলিশ নারী ছিলেন একজন স্বনামধন্য পদার্থ ও রসায়নবিদ। তেজষ্ক্রিয় পদার্থের নানা বৈশিষ্ট্য প্রমাণের জন্য তিনি নানা ধরণের উদ্ভাবন করেন। তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময় তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর দিক মানুষের অজনা ছিল। পরীক্ষায় তার দেহে রক্তশূন্যতা ধরা পরে যা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার নোটবুকটি সীসা নির্মিত বাক্সে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বিশেষঃ কেয়ামতের ঘড়ি- ডুমস ডে ক্লক
১০) ক্যারেল সোজেক
(১৯শে এপ্রিল, ১৯৪৭ – ২০শে জানুয়ারি, ১৯৮৫)

নায়াগ্রার নিচে ভাসমান ক্যারেলের জলরোধী ড্রাম
চেকস্লোভাকিয়ায় জন্ম নেওয়া এই ক্যানেডিয়ান স্টান্টম্যান নিজের তৈরি একটি ব্যারেল এ চেপে নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে প্রায় অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসেন। সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি টেক্সাসের হিউস্টোন অ্যাস্ট্রোডোমে এই কির্তীর নমুনা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। অ্যাস্ট্রোডোমের ছাদ থেকে একটি পানির ট্যাংক এ লাফিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু সৌভাগ্য তার সাথে ছিলনা। ট্যাংক এর ধারের উপর পতিত হন। মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় পর দিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুনঃ ১০টি দুর্ঘটনা, যা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিমান চলাচল হয়েছে আরো নিরাপদ
বিশেষ ঃ আধুনিক যুগের যে সব প্রযুক্তি হাজার বছর আগেও ছিল (পর্ব-১)
