প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হতো, এখন রিমা চা নিয়ে আসবে। বাসিমুখে চা খাওয়া আমার অনেক দিনের অভ্যাস। আদিবকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে। ঘুমের ঘোর কাটলে মনে পড়ে, রিমা বা আদিব কেউ এখানে নেই এখন।
আদিবকে আমার সাথে রাখতে পারিনি, কোর্ট রিমার পরিবারের পক্ষে রায় দিয়েছে। চেষ্টা করেছিলাম। অনেক জায়গায় টাকা খাইয়েছি। লোক ধরেছি বিস্তর। কাজ হয়নি। শালার জাজ। নীতিবাগিশের বাচ্চা!
ছেলেটা আমাকে ভালোবাসতো খুব। মাকে বেশি ভালোবাসো না বাবাকে- কেউ প্রশ্ন করলে একটু চিন্তা করার ভান করে উত্তর দিত, বাবাকে। নিজেকে বিজয়ী মনে হতো তখন। রিমার বড় দুঃখ ছিল এই নিয়ে।
ছোট্ট সুখের সংসার ছিল। কিছুই ধরে রাখতে পারিনি। সময় খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অনেকটা। কখন একটা ভয়ঙ্কর স্রোত এসে সবকিছু বদলে দেবে তার ঠিক নাই!
আমি, রিমা। আমি, রিমা, আদিব। আমি।
তারপর ?
আমি এলকোহলে খাবি খেতে খেতে চিন্তা করি। এলকোহল বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে।
ঘোরের মতো দিন কাটে আমার। সকালে উঠি, অফিসে যাই, কাজ করি, বাড়ি ফিরি। কিছুক্ষণ টিভি দেখি, ম্যাগাজিন পড়ি। মদ খাই। ঘুমাই। কখনও সোফায়, কখনও বিছানায়। একই রুটিন সাইকেলের মতো চলতে থাকে। নতুনত্ব নেই, উত্তেজনা নেই। নতুনত্বের অভাববোধও নেই। নেশা ধরছে। আর এলকোহল না। বিছানায় যাওয়া দরকার। বিছানাটা যেন কোন দিকে?
কিছু একটার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাথা অসম্ভব ভারী হয়ে আছে। বিছানা বরাবর দেয়ালঘড়ি, দেয়ালঘড়িতে তিনটা বাজে। এতো রাত্রে কীসের শব্দ? ব্যাপারটা বুঝতে অনেকক্ষণ সময় লাগল। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। আর একটা ধাতব হাসির আওয়াজ। রান্নাঘরটা আমার শোবার ঘরের পাশেই। কিছুটা কোনাকুনি। আমার বিছানা থেকে রান্নাঘরের অনেকটা দেখা যায়। ধাতব আওয়াজটা চিনতে পেরেছি।
আদিবের একটা পুতুল ছিল। আমি ওকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলাম। পুতুলটা এভাবে হাসতো সুইচ টিপে দিলে।
চা পাতার মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে । টুংটাং আওয়াজটা কীসের বোঝা যাচ্ছে। চা করছে কেউ একজন।
আমি উঠে বসলাম। ঘর অন্ধকার। বিকট অন্ধকার। রাতে কী বাতি বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম নাকি লোডশেডিং চলছে? মধ্যরাতে চা তৈরির শব্দ আর ধাতব হাসি যে স্বাভাবিক না এটা বুঝতে আমার বেশ সময় লাগল। আমার ভয় পাওয়া উচিত- এই অনভূতিটা এখনো কাজ করছে না সম্ভবত। মিষ্টি ঘ্রাণটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। হাসির আওয়াজটা কী আরো বাড়লো বলে মনে হচ্ছে? আমি কী স্বপ্ন দেখছি?
টের পেলাম, আমি ভয় পেতে শুরু করেছি। তীব্র ভয়।
ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। আমার নেশার ঘোর এখনো কাটেনি। নেশার ঘোরে ভুল দেখছি। রিমা আর আদিবের কথা চিন্তা করতে করতে অবচেতন মন ওদের স্মৃতিকে অস্তিত্বে রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে।
নেশার ঘোর কী আসলেই কাটেনি? ঘ্রাণটাও কি মনের ভুল? ভুল কি এতো স্পষ্ট হয়?
গুণগুণ গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মুগ্ধ করা সুর না, আতংকে হাঁড় কাঁপিয়ে দেয়া সুর। একবার মনে হচ্ছে সুরটা রান্নঘর থেকে ভেসে আসছে, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে জানালার বাইরে থেকে, যেন কারও শরীর ধারন করে সারা ঘরময় দাপাদাপি করে বেরাচ্ছে।
পুতুলের ধাতব হাসির শব্দটা বেড়েই চলেছে।
আদিবের পুতুলটা আমি নিজের হাতে ভেঙ্গেছিলাম। আদিব আমাকে খুব ভালোবাসতো, কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। ভয় পেত প্রচণ্ড। তবে সবসময় না। যখন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকতাম, তখন। মাতাল হয়ে প্রচণ্ড পেটাতাম রিমাকে। আদিব থরথর করে কাঁপতো। তখন কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছু থাকতো না আমার। সবকিছু ভুলে যেতাম। এমনই এক মুহূর্তে প্রচণ্ড আক্রোশে আদিবের পুতুল আছাড় মেরে ভেঙ্গেছিলাম আমি। আদিব কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল সেদিন। ভয়ে, দুঃখে।
অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে মারা গেছে রিমা। আমার প্রতি অনেক আক্রোশ নিয়ে।
সেই পুতুলটা হাসছে। আদিবের পুতুলটা হাসছে। আক্রোশের হাসি। সে কি শোধ নিতে এসেছে? কী শোধ নিতে চায় সে?
একটু আলো দেখার জন্য কী না করতে পারি এখন, একটুকু আলো! দমবন্ধ করা নিকষ অন্ধকার, অশরীরী সুর আর ধাতব হাসি। চিৎকার করতে চাইলাম আমি, গলা দিয়ে শব্দ বের হল না এতটুকু। হাসির উৎস রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমার শোবার ঘরের দরজার কাছ থেকে শব্দ আসছে এখন। আরও এগিয়ে আসছে। আরো। কোথায় যাব আমি এখন?
বিছানায় আমার পাশে বসে গান গাইছে কেউ। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট, টানা টানা সুর। অবাস্তব, অপার্থিব সুর।
চোখ বন্ধ করলাম আমি। সব মিথ্যে। সব ভুল। আমার মনে যে পাপবোধ ছিল, তারই ফসল এই ভ্রম। আর কিছু না। আর কিছু নেই। এই গান, পুতুলের হাসি, রান্নাঘরের হাসি সব মিথ্যে, সব কল্পনা, সব আমার মনের ভুল।
অশরীরী বলতে কিছু নেই, থাকতে পারে না। আমি যুক্তিবাদি। যুক্তির কাছে কল্পনা হার মানতে বাধ্য। চোখ খুললেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে।
চোখ খুললাম। কোন শব্দ নেই। ঘড়ির কাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। টের পেলাম, সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে আমার।
কালই গিয়ে আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইব রিমার পরিবারের কাছে । আমার মনের অপরাধটুকু হালকা হবে অন্তত।
কাঁচের শাঁর্সির ওপাশে ওটা কার মুখ? চাঁদের আবছা আলোয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে পুতুলটার চেহারা। নিষ্পলক চোখ, মুখে বিদ্রুপের হাসি। রান্নাঘর থেকে পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কার আওয়াজ?
রিমা?
