পৃথিবীতে সব থেকে মজার এবং সুন্দর সংখ্যা হলো “০” বা “শূন্য”। শূন্য এর আবিস্কার ছিলো গণিত তথা বিজ্ঞানের সব থেকে শ্রেষ্ঠ আবিস্কারের মধ্যে একটি। শূন্য বাদে গনিতের চিন্তা বলতে গেলে একরকম থেমে যায়। গণিত থেমে গেলে বিজ্ঞানও একরকম থেমে যায়। সেই শূন্যের ইতিকথা রয়েছে। রয়েছে ইতিহাস।
পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতার নিজ নিজ সংখ্যাপদ্ধতি ছিলো। তারা সেই সংখ্যা পদ্ধতি নিজেদের প্রয়োজনে হিসেব নিকেশের জন্য ব্যবহার করতো। সেখানে আবার সকল সভ্যতার সংখ্যা পদ্ধতিতে শূন্যের প্রচলিন ছিলো না। যদি প্রচলিত থাকেও, সেটা আবার সংখ্যা পদ্ধতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো না। এরকম নানা সভ্যতার অনেক গণিতবিদদের প্রচেষ্টা বা হিসেব নিকেশ কিভাবে আরও সুন্দর সহজ করা যায় তার চিন্তা থেকে এই শূন্যের আবিস্কার।
পৃথিবীর প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা গুলোর মধ্যে একটি সভ্যতা হলো মিশরিয় সভ্যতা। তারা সেই সময় এর কথা ধরলে হিসেবে নিকেশে বেশ উন্নত ছিলো। সেই প্রাচীন মিশরীয় সংখ্যাপদ্ধতি ছিলো দশ ভিত্তিক। তাদের সংখ্যাগুলো আবার স্থানভিত্তিক ছিলো না। ছিলো চিত্র ভিত্তিক। চিত্র এঁকে এঁকে তারা একেকটা সংখ্যা বুঝাতো।
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দেড় হাজার বছর আগে মিশরিয়রা তাদের আয়কর ও হিসাবরক্ষণের জন্য শূন্যের বদলে একটি চিত্রের ব্যবহার করত। সে ব্যবহার এখনকার “০” মতো যদিও ছিলো না। তাদের চিত্রলিপিতে ছিলো “নেফর” বলে একটা চিত্র, যার অর্থ হল “সুন্দর”। এই চিত্রটি তাঁরা দশ ভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতো। প্রাচীন মিশরীয় পিরামিড এবং নানান স্থাপনায় এ ধরনের চিত্র ভিত্তিক সংখ্যার ব্যবহার পাওয়া যায়। তবে এই চিত্রটি তারা সরাসরি হিসেব নিকেশে ব্যবহার করতো না।
আরেকটি অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা হলো মেসোপটেমীয়া সভ্যতা। এই মেসোপটেমীয়ানারা বা ব্যাবিলনীয়রা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার বছর আগের মাঝামাঝি সময় এ ছয়ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা ব্যবহার করতো। যেখানে শূন্য বলতে কিছু ছিলো না। তবে তারা ছয় ভিত্তিক সংখ্যার মাঝে একটা ফাঁকা যায়গা ব্যবহার করতো। তার প্রায় দেড় হাজার বছর পর, খৃষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে অই ফাঁকা যায়গার বদলে দুটি যতিচিহ্ন এর মতো দেখতে একটি প্রতিক বানিয়ে ব্যবহার শুরু করতো। পরে তারা এই যতিচিহ্নের বদলে একটি “হুক” এর মতো চিহ্ন দিয়ে ফাঁকা প্রকাশ করেছিলো।
কিন্তু এসব শূন্যের ব্যবহার শুধুমাত্র ফাঁকা যায়গা কিংবা কিছু নেই বোঝাতেই ব্যবহার হতো। সরাসরি সংখ্যাপদ্ধতির হিসেবে এসবের ব্যবহার ছিলো না। ব্যাবিলনীয় শূন্যটি প্রকৃতপক্ষে শূন্য হিসেবে গন্য করা সমীচীন হবে না কারণ এই প্রতীকটিকে স্বাধীনভাবে লিখা সম্ভব ছিল না কিংবা এটি কোন সংখ্যার পিছনে বসে কোন দুই অঙ্ক বিশিষ্ট অর্থবোধক সংখ্যা প্রকাশ করত না।
প্রাচীন চীনেও তাদের সংখ্যা পদ্ধতিতে একটা ফাঁকা যায়গা ব্যবহার হতো।
এছাড়াও লাতিন আমেরিকান মায়া সভ্যতায় তাদের সংখ্যাপদ্ধতিতেও তারা একটা ফাঁকা ঘরের মতো ব্যবহার করতো এবং ইনকা সভ্যতায় তারা দশভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিতে কিছুনা বোঝানোর মতো করে একটা প্রতিক ব্যবহার হতো। যা কোনোটাই আজকের শূন্যের সাথে মিল নেই এবং সংখ্যাপদ্ধতির অংশ ছিলোনা।
তারপর আসি ইউরোপিয় অঞ্চলের দিকে।
ইউরোপিয়দের মধ্যে রোমান সংখ্যা পদ্ধতি আবার দশ ভিত্তিক হলেও তাদের সংখ্যা পদ্ধতিতে শূন্য বা ফাঁকা বা কিছুনা বলতে কিছু ছিলো না। তারা আবার এঁকে হলেও নির্দিষ্ট কিছু হরফে তাদের সংখ্যা পদ্ধতি প্রকাশ করতো। তারা ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ কে তারা যথাক্রমে I, II, III, IV, V, VI, VII, VIII, IX আকারে প্রকাশ করতো। নয় এর পরে দশ বোঝাতে তারা “X” লিখতো। সেখানে শূন্য বলতে কিছু ছিলো না। রোমানদের সংখ্যা ব্যবস্থা বেশ উন্নত হলেও তারা অত্যন্ত জটিল ভাবে তাদের সংখ্যা লিখতো। যেমন, ধরুন আপনি লিখবেন ২০১৮. তারা এই ২০১৮ লিখতো MMXVIII রুপে।
এবার আসি শূন্য এর সবচেয়ে উন্নতির এবং আবিস্কারের কাছাকাছি গল্পে।
এই শূন্যকে কোনো সংকেত বা প্রতিক বা কোনো কিছু না বুঝিয়ে সরাসরি সংখ্যা হিসেবে সংখ্যাপদ্ধতিতে সফলভাবে ব্যবহার এর কৃতিত্ব এই ভারতবর্ষের গণিতবিদদের। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১০০০ অব্দের আগে তার মানে আজ থেকে প্রায় ৩০০০ বছর আগে ভারত বর্ষের গণিতবিদেরা বাস্তব সংখ্যা নিয়ে যখন হিসেব নিকেশ করতেন তখন তারা শূন্যকে সরাসরি সংখ্যা এর মতো করে ব্যবহার করতো। যদিও এর নাম “শূন্য” কিংবা দেখতে এখনকার শূন্যের মতো ছিলো না। কিন্তু তারা শূন্যকে ব্যবহার করে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ এর কাজ করতো।
খ্রিস্টপূর্ব ৫শ অব্দের দিকে মানে এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষের গণিতবিদেরা দুই ভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতিতে হিসেবনিকেশ করার পদ্ধতি বের করেন এবং তা হিসেব নিকেশে ব্যবহারও করতেন। যার নাম তারা দিয়েছিলো “পিঙ্গলা।” সেই “পিঙ্গলা” ই আজকের “বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি” হিসেবে আমরা জানি। তারা একটি বড় অক্ষর এবং একটি ছোটো অক্ষরের সমন্বয়ে বানানো দুইভিত্তিক হিসেবে হিসেব করতো। যা বর্তমান মোর্স কোডের মতো।
ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট কেই শূন্যের আবিস্কারক হিসেবে বলা হয়। তার একটি বই এ লেখা পাওয়া যায় “স্থানম স্থানম দশ গুনম।” মানে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন স্থানে স্থানে দশ গুনের কথা। এখানেই অনেকটা শূন্য লুকায়িত ছিলো বলে বলা হয়। তাঁর “মহাসিধ্যান্ত” গ্রন্থে বলা আছে, ‘এমন একটা সংখ্যা যার সাথে কোনো সংখ্যা যোগ কিংবা বিয়োগ করলে সংখ্যাটি অপরিবর্তিত থাকে এবং গুন করলে সংখ্যাটি শূন্য হবে।‘
শেষ পর্যন্ত এই শূন্যকে পূর্ণ সংখ্যার রুপ দেয় আরেক ভারতীয় গণিতবিদ ব্রহ্মগুপ্ত। তার “ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত“ নামক বই-এ প্রথম শুন্যকে সংখ্যা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। শূন্যের সাথে যোগ, বিয়োগ, গুণের কথা এই বই-এ বিশদ ভাবে এবং সঠিকভাবে দেয়া হয়।
কিন্তু শূন্য দিয়ে ভাগ এর কোনো বিবরন এতে ছিলোনা। শূন্যের ভাগ নিয়ে বিবরণ পাওয়া যায় গণিতবিদ ভাস্করাচার্য এর “লীলাবতী” গ্রন্থে। সেখানে তিনি বলেন, ‘শুন্য দ্বারা কোনো সংখ্যাকে বিভাজিত করলে ভাগফল হবে অসীম।‘
এটাই হলো শূন্যের আবিস্কার।
এর পরে আসা যাক এই শূন্য এর প্রতিক কিভাবে “০” হলো,
শূন্য এর প্রতিক “০” হওয়া নিয়ে নানান মত প্রচলিত।
ইউরোপের গ্রীকরা এই শূন্যের ব্যবহার অন্য ভাবে করতো। তারা ফাঁকা বা কিছুনা বুঝাতে “omicron” নামে একটি শব্দ ব্যবহার করতো। যা আবার “ouden” নামেও পরিচিত। “০” প্রতিকটি এখান থেকে আসতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
আবার গ্রীক দার্শনিক টলেমী কিছু না বুঝাতে “o” এর ব্যবহার করতো। যা ছিলো তখনকার স্থানীয় গ্রীক শব্দ “ouser” এর প্রথম অক্ষর। “ouser” এর অর্থ ছিলো কিছুই না। অনেকের মতে প্রতিকটি এখান থেকে এসেছে।
অনেকে আবার মনে করেন প্রাচীন ইউরোপে “obal” নামে একটা মানহীন মুদ্রা প্রচলিত ছিলো। এই “obal” থেকেও এই “০” প্রতিকটি আসতে পারে।
সবশেষ ব্যাপার হলো শূন্য কিভাবে ইংরেজিতে “Zero” নাম হলো।
ভারতে শূন্যের আবিস্কার হয় বলে তখনকার ভাষা সংস্কৃত তে এর নাম দেয় “शून्य” (শূন্য)। যার মানে “কিছুনা” বা “ফাঁকা।“ আরবীয়রা বা পারসিয়ানরা যখন এই ভারতবর্ষীয় সংখ্যা পদ্ধতি গ্রহণ করে তখন তারা শূন্যকে “safira”( صفر বা সাফিরা) বা “sifr” (সিফর) বলে অনুবাদ করেছিলো। সেই সংখ্যা পদ্ধতি যখন “হিন্দু-আরবীয় সংখ্যাপদ্ধতি” হিসেবে আইবেরিয়ান পেনিনসুলা বা আইবেরিয়ান উপদ্বীপ হয়ে ইতালীয় গণিতবিদ ফিবোনাক্কি অথবা লিওনার্দো অফ পিসা মারফত ইউরোপে প্রচলিত হয়। ফিবোনাক্কি এই সংখ্যাব্যবস্থাকে ইউরোপে “জেফাইরাম।” নামে ব্যবহার করে। তখন এই “sifr”(সিফর) এর ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ ছিলো “zefiro” (জে ফিরো) তা থেকে ইতালীয় ভেনেটিয়ান রুপ এ “zevero” (জেভেরো) নাম আসে। তারপর লিওনার্দো অফ পিসা “sign 0” (সাইন জিরো) বলে কথার ব্যবহার করেছিলেন। এই জিরো থেকে ফ্রেঞ্চ “zéro” শব্দ আসে। আর সেখান থেকে ইংরেজি “zero”।
লিখেছেনঃ অর্জিষ্মান রায়।
