আমাদের বর্তমান চলচ্চিত্র ইতিহাস এবং অতীত ইতিহাসের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। চলচ্চিত্রের অতীত ইতিহাস ছিল দাম্ভিকতা পূর্ণ এক ইতিহাস, মধ্যে অশ্লীলতার যুগ পার করলেও বর্তমান ইতিহাস সেক্ষেত্রে কোনো লাভের মুখ দেখাতে পারেনি। চলচ্চিত্র একটা শিল্প, যারা কাজ করে তারা শিল্পী। মাঝে মাঝে উত্থান-পতনে কেউ হারিয়ে যায়, আবার কেউ টিকে থাকতে নিজেকে খোলামেলা ভাবে প্রকাশ করে। আর সেটাকে এক কথায় বলা যায় অশ্লীলতা।
চলচ্চিত্র মানেই কি প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা? হ্যাঁ, একদিকে তা হতে পারে, তবে সেটা যদি শিল্পের সাথে সংগতি থাকে। আমরা কেনই বা অশ্লীলতাকে চলচ্চিত্র ভেবে বসে থাকবো? আমার এইসব কথাবার্তা একদমই আমাদের দেশ-কেন্দ্রিক। হলিউড বা বলিউড এর আলাপ আমি করছি না। আমি আলাপ করছি আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি যেটা অনুমতি দেয় সেটাই সই।
শ্লীল-অশ্লীল নিয়ে বিতর্কঃ কিছুদিন আগে একটি জাতীয় পত্রিকায় আইনজীবী আফতাবউদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব তার লেখাতে অশ্লীলতার সংজ্ঞা দিয়েছেন ঠিক এমনভাবে, “সাধারণভাবে লজ্জাহীনতা, রুচিহীনতা, অসুন্দর ও অশোভনের সামষ্টিক রূপ হল অশ্লীলতা। অন্যভাবে ‘অশ্লীলতা’ (ইংরেজিঃ Obscenity ) হল একটি পরিভাষা, যা এমন সব শব্দ, চিত্র ও কার্যক্রমকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়; যেগুলো কিনা সমসাময়িক অধিকাংশ মানুষের যৌন নৈতিকতার দৃষ্টিতে অপরাধ বা দোষ হিসেবে বিবেচিত। তবে বিষয়টি প্রচণ্ড আপেক্ষিক। স্থান, কাল-পাত্র ভেদে ‘অশ্লীলতার’ রূপ বদলায়, বদলায় রং। আমি যে কারণে বলছি আমাদের সাথে বাহিরের কোন দেশ বা কোন ইন্ডাস্ট্রির তুলনা না দিতে।যেমন আমরা দেখতে পারি ডিএইচ লরেন্সের ‘লেডি চাটার্লিজ লাভার’ বইটা। সঙ্গমের রগরগে বর্ণনা সংবলিত এই বইটার কপালে অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের আদালত ‘অশ্লীল’-এর তিলক এঁকে নিষিদ্ধ করেছে, প্রকাশক-পরিবেশককে শাস্তি দিয়েছে, একই বইকে ইংল্যান্ড, আমেরিকাও কানাডার সর্বোচ্চ আদালত বলছে ‘শ্লীল’। যৌনতার সুড়সুড়িতে ভরা সমরেশ মজুমদারের যে ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসকে কলকাতার নিন্ম আদালত ও হাইকোর্ট অশ্লীলের শিরোপা পরিয়ে উপন্যাসের সব কপি বাজেয়াপ্ত করেছে, ওই উপন্যাসকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘শ্লীল’-এর সনদ দিয়েছে। শিল্প-সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল এ দ্বন্দ্বটা অনেকটা বিশ্বজনীন। তা ছাড়া শিল্প বা সাহিত্য শ্লীলতা-অশ্লীলতা বিচারের সুনির্দিষ্ট কোনো পাল্লাও নেই। এ ক্ষেত্রে ‘হিকলিন টেস্ট’ই (Hiklin Test) বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি। যা অনুভূূতি প্রবণ থেকে কলুষিত করে এবং নৈতিক অধঃপাতে নিয়ে যায়, তাই অশ্লীল। এটাই হচ্ছে, হিকলিন টেস্টের মূল কথা। ইংল্যান্ডের ‘রেজিনা বনাম হিকলিন’ (১৮৬৮) মামলায় এ তত্ত্বের জন্ম”। (যুগান্তর- বিনোদন পাতা ১১/৮/২০১৭)
সুতরাং কেউ যদি এখানে গেম অফ থ্রোন্সের উদাহরণ টেনে আনে, তাহলে সে মগজ খালি একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। নতুনভাবে আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে অশ্লীলতার হাওয়া এলো বলে।
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে অশ্লীলতার কালো থাবা পড়ার আগেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমার আজ এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য হল চলচ্চিত্র বা মিউজিক ভিডিওতেই যদি নগ্নতা, অশ্লীলতা দেখতে হয় তাহলে সেটাতো আমরা পর্ন সাইট গুলো থেকে আরো সুন্দর এবং মনোরম পরিবেশে দেখতে পারি। কেনো পরিবার ও মুরুব্বিদের সামনে এইরকম অশ্লীল সিনেমা বা অন্যান্য কিছু দেখে আমরা পরষ্পর লজ্জিত হচ্ছি?
আর এখানেই আমি আলোচনা করবো বাংলাদেশ এবং বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের পর্ন আসক্ত মানুষ এবং তাদের সংখ্যা নিয়ে।
২০০৫ সালে বিশ্বের ৫০০ মিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট সেবা ভোগ করতো, সেখানে ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ শতাংশ (৩ বিলিয়ন) মানুষ। যদিও এখনো ৪.২ বিলিয়ন মানুষ এ সুবিধের বাইরে। ইউরোপিয়ান সবচেয়ে বেশি (৭৫ শতাংশ) এবং আফ্রিকা সবচেয়ে কম (২০ শতাংশ) এই সুবিধা ভোগ করে। তবে বিশ্ব ইন্টারনেট পরিসংখ্যানের হিসেব মতে, মোট ইন্টারনেটের অর্ধেক ব্যবহার করে এশিয়ানরা, দুই আমেরিকা ১৯.৫ শতাংশ, ইউরোপ ১৮ শতাংশ ও আফ্রিকা ৯.৮ শতাংশ।
ইন্টারনেট গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ এর মতে ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সালে বিশ্বের ৮ শতাংশ মানুষ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করলেও পরবর্তী নয় বছরে এই সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এখন মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭৪ শতাংশ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করছে। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের আওতায় রয়েছে ১.৯৬ বিলিয়ন,ধারণা করা হয় ১৮ সাল নাগাদ যা বৃদ্ধি পেয়ে ২.৪৪ বিলিয়ন হবে।
সোশাল নেটওয়ার্কিংয়ের পর যে ওয়েবসাইটগুলো মানুষকে আকৃষ্ট করে তুলছে তা হল ‘পর্নোগ্রাফি’। বিশ্বের মোট ওয়েবসাইটের ১২ শতাংশ (৪.২ বিলিয়ন) পর্নসাইট।
অ্যালেক্সার মতে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৬৫.৫ শতাংশ লোক পর্ন দেখে এবং চারশত মিলিয়ন ওয়েবসাইটের উপর করা জরিপের ফল থেকে জানা যায় প্রতি আটটি ক্লিকের একটি যৌন সাইট। এই খাতের ইনকামও কিন্তু মন্দ নয়। ২০১৫ সালে শুধু এই খাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শীর্ষে আমেরিকা (৪০ মিলিয়ন) যাদের প্রতি তিনজনের একজন মহিলা, ২য় ব্রাজিল, ৩য় পাকিস্তান এবং ৪র্থ চীন।
শতকরা হিসেবে বেশি পর্ন ভিজিটকারীদের দেশ পোল্যান্ড (প্রতি দশ হাজার জনের ৮৫ শতাংশ), ২য় স্থানে আছে মিশর। বিখ্যাত পর্নের সাইট হিসেবে পরিচিত পর্নহাব ডট কম তাদের এক পরিসংখ্যানে বলেছে, “২০১৫ সালে তাদের ওয়েবসাইট ভিজিট হয়েছে মোট ২১.২ বিলিয়ন বার, মিনিটে ৪০ হাজার বার ভিজিট বা ঘন্টায় ২.৪ মিলিয়ন বার”।
এইবার আসি বাংলাদেশের হিসেবে। বাংলাদেশের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩২ শতাংশ- প্রায় ৫ কোটি ২২ লাখ। কিন্তু জাতিসংঘের মতে এই ব্যবহারীর সংখ্যা দেড় কোটি, যেখানে বিশ্বে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩৪২ কোটি এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৭৯ কোটি এবং বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর মোট সংখ্যা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি আছে। যদি ব্যবহারকারী ২ কোটি বা ৩ কোটি হয় তাহলে দেখা যাবে এর অর্ধেক ভুয়া আইডি মানে একজনের দুই-তিনটা আইডিও এর মধ্যে পড়ে, বলেছিলেন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান।
বাংলাদেশে যে পর্নের ব্যবসা ওইরকম বিস্তৃত না, সেটা চিন্তা করার উপায় নেই। বাসসের প্রকাশিত রিপোর্টে (জুলাই, ২০১৩) বলা হয়েছে ঢাকার বিভিন্ন সাইবার ক্যাফেতে প্রতি মাসে ৩ কোটি টাকা মূল্যের পর্ন ডাউনলোড করা হয়। এ সকল পণ্যের ৭৭ শতাংশ স্কুলকলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে! সরকার কি এইসব ওয়েবসাইট বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা না জানি না, তবে দেশের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকিয়ে এইসব বন্ধের এখনই সময় বলে মনে করি।
শুধু ওয়েবসাইটে না, পর্ন এবং অশ্লীলতার রমরমা কারবার ফেসবুকেও দেখা যায়। অনেক ক্লোজ গ্রুপ বিভিন্ন নাম দিয়ে আনসেন্সরড লোগো লাগিয়ে অশ্লীলতাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এইসব গ্রুপে খোলাখুলি ভাবে অশ্লীল, বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয় যেখানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে।
আমি মনে করি, যৌনতা বা অশ্লীলতা নিয়ে সরাসরি কথা বলার এখনই উত্তম সময়। সবারই যৌনানুভূতি আছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমাদের উচিৎ আমাদের অপরাধ আমাদের ব্যক্তির মাঝে সীমাবদ্ধ করে রাখা, আমাদের এইসব অশ্লীল এবং বিকৃত চিন্তাভাবনা কারো ক্ষতি করতে না পারে এবং সমাজে যেনো এর কুপ্রভাব বিস্তৃত না হয় এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, যুগান্তর, প্রথম আলো এবং অন্যান্য অনলাইন রিসোর্স।
