[১]
ভোর সাড়ে চারটায় যখন ডাম্বুল্যে, পৌঁছালাম কলম্বো ফোর্টের সুন্দর আরামদায়ক বাসটা বলা নেই কওয়া নেই মোকামতলার মতো গ্রাম্য হাটে, নিশুতির মাঝে নামিয়ে দিয়ে ত্রিংকোমালের দিকে ছুটে গেলো। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো কিছু খোলা দেখলাম না। দেখলাম দুই তিনজন টুকটুক ওয়ালার মধ্য থেকে বিশালাকায় একজন এগিয়ে এলো। অতি উৎসাহীর প্রথম কথা ‘মাইসেল্ফ ইন্ডিকা। ইউ স্যার গোইং কান্ডালামা? ইট ইজ থ্রু দা জাঙ্গাল’। সুবাসে টের পেলাম অতিকায় মহাশয় ছয়বেলা প্রমাণ সাইজের পান খায় সে আর বিশ্রিভাবে হাসতেই থাকে। এই লোকই পারবে ভোরবেলার পিক-টাইমে ‘কওশন! এলিফ্যান্ট ক্রসিং’ সাইনের মধ্য দিয়ে জঙ্গল পার করে কান্ডালামা লেকের পাড়ে আমাদের কিংবদন্তীতুল্য হেরিট্যান্স হোটেলে।
শ্রীলঙ্কার একটি কন্সট্রাকশন প্র্যাকটিস হলো কাঁচা রাস্তায় বা বাড়ির আঙিনায় লাল সুরকি ঢেলে দেয়া। তাতে বর্ষার পানি খুব সহজে ড্রেইন হয়ে যায় এবং কাদার প্যাঁচপেঁচি থাকেনা। শ্রীলঙ্কায় বর্ষা দুটো। উত্তর-পূর্বের আর দক্ষিণ-পশ্চিমের, দুটো দু’ সময়ের হলেও আগে পরে কিছু সময় আশপাশে বৃষ্টি দিয়ে যায়। হিসেবটা একটু কম্প্লিকেটেড বিধায় সহজ ভাবে বললে আমরা গিয়েছিলাম ড্রাই সিজনের শুরুতে। তার পরও কিছু বৃষ্টি পেয়েছিলাম, দেখেছিলাম লিমিটেড রিসোর্সে কতোটা সোজােকরে ড্রেনেজের সমাধান করেছে সিংহ-বাহিনী। কতোটা ছিমছাম করে যে যার জায়গাটা সামলেছে, গুছিয়ে রেখেছে, পরিস্কার রেখেছে। যাহোক, দশ ফুটের পাকা রাস্তা ফেলে আমরা অনিশ্চিত অন্ধকারের ভেতরে ছুটতে ছুটতে সেই সুরকি-রাঙা মাটির রাস্তায় এসে গেলাম। ডানপাশে পত্রপতনশীল গাছের বন, বাম পাশে শ্রাব-ফরেস্ট হয়ে বিশাল কান্ডালামা রিজার্ভোয়ার। হাইওয়ের মতো এখানে ইলেক্ট্রিক তার দিয়ে ফেন্সিং নেই। ইন্ডিকার ভাষ্যমতে হাতিরা ভোর বেলাই রাস্তা পেরিয়ে আসে লেকের পানি খেতে। ছমছমে অন্ধকারে পেলাম ফিল্ডের পুরনো একটা ‘সাইন’ – দিনের শুরুতে বনমোরগ পেলে ফিল্ডে দিন ভালো যায়। সূর্য ওঠার ঠিক আগ মুহুর্তে হুঁশ করে টুকটুক উঠে গেল ছোট একটি পাহাড়ের গায়ে করা রাস্তা বেয়ে।
ঠিক যেন প্রাচীন কোন গুহার মুখের ন্যায় ‘porte cochère’ থেকে টিমটিমে আলোয় উন্মুক্ত রিসেপশনের সামনে আমাদের নামিয়ে দিলো বন্ধু ইন্ডিকা। সকালে দেখা হবে কথা দিয়ে বিদায় নিলো সে। ‘আইবোয়া’ বলে ঐতিহ্যবাহী পোষাকে স্বাগতম জানালো আমাদের অভ্যর্থনা থেকে বেরিয়ে। আমাদের চেক-ইন ছিলো দুপুর দুইটা থেকে। রাতেই ফোনে কথা বলে এসেছিলাম, ক্লোক রুমে লাগেজ রেখে লাউন্জে অপেক্ষা করতে পারবো কিনা। আমরা দু’জন সদ্যবিবাহিত স্থপতি জেনে তারা নির্ধারিত সময়ের প্রায় দশ ঘন্টা আগেই আমাদের রুম অ্যালোকেট করে ফেলে। আরো অবাক হই যখন দেখি আমাদের সবচেয়ে নজরকাড়া লাক্সারি প্যানোরামা রুমের বন্দোবস্ত করে দেওআ হয়েছে। হোটেলের পঞ্চম তলার বহুল আকাঙ্খিত মূল প্রবেশটি ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে পাথুরে পাহাড়, আমরা পাহাড়ের গায়ে যেমন ‘পাহাড় ফুঁড়ে’ বেরিয়ে যাই, ঠিক তার উল্টো – ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত। সেই পাহাড়ের গুহা-সদৃশ মুখ দিয়ে হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম ৫০৫ নম্বর রুমে।
রুমের বারান্দায় দু’জনের টেবিলে বসে মুগ্ধ হয়ে নি:সন্দেহে জীবনের সুন্দরতম ভোরটা দেখলাম আমরা… কি নেই তাতে? দূরে সিংহের ন্যায় উপবিষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন সিগিরি রকফেস, এরপর রহস্যময় কান্ডালামা লেক ভর্তি বক, পানকৌরি, পেলিক্যান, গঙ্গাকৈতর আর নাম না জানা হাজার হাজার পাখি। এর পরে লেক পারের বাদা-বন এসে মিশেছে হোটেলের মিহি-ছাঁটা লনের ল্যান্ডস্কেপে। শয়ে-শয়ে আবাবিল, যারা হোটেলের গায়েই বাসা বেঁথে সংসার পেতেছে, নিরবচ্ছিন্নভাবে উড়েই চলেছে ভোর হবার আনন্দে। দিনের শুরুটা স্বভাবসুলভ হাঁক-ডাকে বাদা-বনের মুখপোড়া হনুমান আর ম্যাকাক বাঁদরগুলোকে জাগিয়ে চলেছে মাছরাঙা, নীলচোখ মালকোয়া, সারস, সুঁইচোরা আর মোচাটুনীরা। ছবি তোলার চেয়ে হাঁ করে প্রতিটি সেকেন্ড গিলবার প্রচেষ্টাই লোকসানবিহীন মনে হলো। রীতিমত প্রাগৈতিহাসিক একটা ভোর পেরিয়ে নিজেরা ঘোর কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম…

পাঁচ তলার উপরে অভ্যর্থনা, বাদ-বাকি হোটেল প্রায় সম্পূর্ণটাই নিচে (গুগলের ছবি)

কামরার জন্য অপেক্ষা
কলোম্বো থেকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত-ঘুমন্ত সহধর্মিনীকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পরলাম – ভোর বেলার সেই ‘গুড সাইন’-কে উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই! হোটেলের করিডোর দিয়ে হাঁটছি আর অবাক হচ্ছি, মনে হচ্ছিলো সত্যিই পাহাড়ের ঢালের পুরো বনটাই ট্রিফার্ণ, ডুমুর, বট আর পাকুর নিয়ে হোটেলের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে নূন্যতম ডিস্টার্ব না করে তৈরী করা ট্রপিকাল আর্কিটেকচারের অনবদ্য কাজটি জিনিয়াস স্থপতি জিওফরে বাওয়ার কাজের একটি জীবন্ত উদাহরণ!
যাহোক, আমাদের ফ্লোরের উচ্চতা করিডোরের বনের ‘ক্যানোপি’র প্রায় সমান। ভোরবেলা তাই হোটেলেই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম ক্যামেরা হাতে – যদি কিছু মেলে! চারপাশে অচেনা পাখির ডাক শুনছি, দু-একটা চোখেও পরছে, কম আলোয় চেনা যাচ্ছেনা হলুদ বুলবুলি নাকি বেনেবউ। চার তলার করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, হুট করে ডান কান ঘেঁষে হুশ করে কিছু একটা গিয়ে সামনের একটা গাছে বসলো, বুঝলাম বড় কোন পাখি। মেঝেতেই ছিলো প্রমাণ সাইজের একটা প্রেয়িং ম্যান্টিস, চোখের নিমেষে বিশাল পাখিটা করিডোরে আসলো, পোকাটা তুলে নিয়া আবার ডালে গিয়ে বসলো। আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে ছবি নিতে পারলাম কয়টা। অবাক হয়ে দেখলাম সে খেয়ে-দেয়ে ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখলো ‘তুমি আবার কে গো, ভাই?’ টাইপ একটা ভাব নিয়ে। মানুষ দেখে এরা মোটেও ভীত না, কেননা এখানে ওরা নিরাপদ। স্থাপত্যকর্মটাও এমন যেন এটি তার প্রাকৃতিক পরিবেশের অংশ হয়ে উঠেছে।

Srilanka Grey Hornbill, আমার প্রথম শ্রীলংকান এনডেমিক পাখি

অধিকাংশ ছবিই হোটেল লবি থেকে তোলা

পুরো হোটেল-জুড়ে পশু-পাখির অবাধ চলাফেরা
[২]
কান্ডালামা হোটেলটি তৈরী করবার সময় Aitken Spence Hotel Group দ্বারা স্থপতি জিওফরে বাওয়াকে কমিশন করা হয়। সৌখিন এবং রীতিমত অভিজাত স্থপতি হিসেবে তখন যথেষ্ট দাপটের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর ‘কোলাবরেটর’দের সাথে। Aitken চাইছিলো খ্রীষ্টাব্দ ৫ম শতাব্দীর রাজা কশ্যপের বিখ্যাত রক-ফরট্রেস সিগিরিয়ারই পাদদেশেই হোটেলটি তৈরী হোক। কিন্তু জিওফরে এই বিশ্ব ঐতিহ্য সাইটকে বিরক্ত না করে কান্ডালামা লেকের ব্যাকগ্রাউন্ডে সিগিরিকে রেখে আরেকটি পাহাড়ের ঢালে, ঠিক পাহাড়ে যেভাবে ঐতিহ্যগতভাবে কন্সট্রাক্ট করা হয়, সেভাবে তৈরী করলেন Aitken Spence এর ফ্ল্যাগশিপ হোটেলটিকে। জিওফরে বাওয়ার কাজের ধরণের Stylistic Shift-এর পরিচায়ক হলেও তার স্থান, কাল ও অবস্থিতির প্রতি তাঁর চিরায়ত সততা বজায় ছিলো।
অনেক গুলো কারণে হোটেলটি অনন্য। এটি পৃথিবীর প্রথম হোটেল যা LEED সার্টিফিকেশন পায় এবং এশিয়ার প্রথম হোটেল হিসেবে এটি Green Globe Certification পায় Eco-Tourism Practice এর জন্য। টেকনিকাল দিক থেকে হোটেলটি কান্ডালামা লেক থেকে এক ফোঁটা পানি না নিয়ে এর সুবিশাল Waste-water recycling plant এবং গভীর কূপের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। আবর্জনার recycling এবং renewable energy’র ব্যবহার হয়েছে এখানে। নব্বই-এর দশকের শুরুতে এসব সত্যিই অচিন্তনীয় সাফল্য তাও আবার ত্রিশ বছরের গৃহযুদ্ধে আহত একটি সংগ্রামী দেশের জন্য তো বটেই! এ সবই হয়েছে পাঁচ তারা হোটেল অ্যামেনিটিজ-ফ্যাসিলিটিজ এ কোন রকম ছাড় না দিয়ে। উপর থেকে দেখলে পুরো স্থাপনাটিকে পাহাড়ের কনটুরলাইনকে সমীহ করে জায়গা করে নিতে দেখা যায়। হোটেলের এমাথা-ওমাথা প্রায় আধা কিলোমিটার লম্বা, এটি করিডোরে না হাঁটলে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই। একদিকে শ্রাব-ফরেস্ট আর লেক, করিডোরের দিকে লম্বা গাছের বন আর পাহাড়। ক্যানোপিতে সকাল-বিকাল এন্ডেমিক স্পিশিজের নানা পাখি, গেছো স্তন্যপায়ীর নির্ভীক উপস্থিতি দেখা যায়। কান্ডালামা হোটেলের রয়েছে নিজস্ব ইকো পার্ক আর এনিমাল রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, হার্ব গার্ডেন, প্লান্ট নার্সারি এবং মিউজিয়াম। পুরো হোটেলের আসবাব এবং সাজসজ্জা যেসব ডিজাইন করেছেন জিওফরে সবই অসম্ভব পোস্ট-মডার্ণ, যথা সম্ভব অর্ণামেন্টেশন বিবর্জিত। কালো কংক্রিটের বিম এবং কলাম বাইরের সবুজকে ফ্রেমে বেঁধে ফেলে। একেকটি জায়গার ‘ভিসতা’ গুলো সুচিন্তিত যেন আর্ট মিউজিয়ামের কোন গাইডেড ট্যুর। বাওয়া চিন্তা করেছিলেন এমন একটি টাইমলেস জায়গার যেখানে একজন প্রকৃতির মাঝে ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে ঘটে যাওয়া-ঘটে চলা ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে হারাতে পারবে। বৌদ্ধ বিহার, প্রাচীন গুহা এবং কান্ডালামার প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ তার ডিজাইনের ইন্সপিরেশন হিসেবে কাজ করেছে। আর কাজ করেছে পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দেয়ার, বনকে বনের মতো থাকতে দেয়ার অপার আগ্রহ। শ্রীলঙ্কান ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের ছায়া রয়েছে ‘লফটি’ লবিস্পেস এবং উঁচু ফ্লোরহাইটে যা কিনা প্রাচীন প্রাসাদ এবং মন্দিরকে মনে করিয়ে দেয়। প্রকৃতিক ল্যান্ডস্কেপের আর হোটেল স্থাপনার কোথায় শুরু কোথায় শেষ নির্দিষ্ট করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায় প্রান্তিক জায়গা গুলোতে দাঁড়ালে। দূর থেকে দেখলে ইনফিনিটি পুলটাকে লেক বলে ভ্রম হয় – মনে হয় স্থাপত্যের ভেতর থেকেই যেন লেকের আরম্ভ, স্থাপত্যের গহীনেই এর শেষ…

© The Architectural Heritage of Sri Lanka: Measured Drawings from the Anjalendran Studio

© The Architectural Heritage of Sri Lanka: Measured Drawings from the Anjalendran Studio

লবি থেকে কান্ডালামা লেক আর এই প্রজেক্টে তৈরী বিখ্যাত ‘কান্ডালামা চেয়ার’

পুলের এক দিকটায় হঠাত টাইলস থেকে পায়ের নিচে পহাড়ের স্পর্শ চমকে দেয়!

মেইন লবি
রুমগুলোতে রয়েছে কাঠে তৈরী ‘রোবাস্ট’ সব আসবাব। বাওয়ার কাজের আরেকটি অন্যতম দিক হল ‘ফাংশনাল ডিটেইলিং’ এর প্রতি ‘অ্যাটেনশন’। ফ্লোর প্ল্যান যথেষ্ট পরিস্কার এবং আসবাব বসানো হয়েছে ‘ক্লাটার ফ্রি’ ভাবে, ঠিক যেখানে-যতটুকু-যেভাবে হওয়া দরকার। বাথরুমগুলো সুপরিসর এবং টাব থেকে ল্যান্ডস্কেপের ভিজুয়াল সম্পর্কের অন্যতম উদাহরণ এটি। পাঁচতলা থেকে নেমে লনে আসলে হোটেল বিল্ডিংকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে যায়, নিতান্তই একটা সবুজ পাহাড় মনে হয় এক্সটারনাল ভেজিটেটেড ট্রেলিসগুলোর কারণে। পশুপাখিরা, বিশেষ করে এখানকার হনুমান এবং বানর সম্প্রদায় হোটেলটিকে তাদের স্থায়ী আবাস বানিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে ম্যাকাক বানরগুলো সকাল হলেই পেয়ে যায় ইন-রুম ব্রেকফাস্টের খবর। দল বেঁধে সকাল থেকে হানা দিতে থাকে রুমগুলোতে। বারান্দার কাঁচে অবশ্য সুস্পষ্ট নির্দেশন/সতর্কতা দেয়া রয়েছে উনাদের সম্পর্কে, যাতে সবসময় বারান্দার দরজা লক রাখা হয়।

‘Warning! Please do not feed us, we can be a real nuisance’

লন থেকে ভিজিটেটেড ট্রেলিস

খুব সাধারণ নিট-সিমেন্ট ফিনিশের ফ্লোর, কাঠ ও বেতের বুনিয়াদি আসবাব

সিগিরিয়া রক, রাজা কশ্যপের দেড় হাজার বছর পুরোনো ফরট্রেসের ধ্বংসাবশেষ

১ম তলার লবিতে; নিচতলাটি কার্যত ফাঁকা
করিডোরে ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে একটার পর একটা এন্ডেমিক প্রাণী স্পট করছিলাম। এরই মাঝে হাসিমুখে দুইবার স্বাগতম জানিয়ে গেলো একই ক্লিনার মেঝে পরিস্কার করতে করতে। দিনের আলো স্পষ্ট হয়ে আসতে ঘোরাঘুরি শেষ করে কামরায় ফিরে আসি। ঘন্টাতিনেক বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে যাই আমরা সিগিরি রকফেস আর পিদুরাঙ্গালের পাহাড়ি বনের উদ্দেশ্যে। ডাম্বুল্যের গ্রামীণ পথ দিয়ে যেতে যেতে সুনসান এক বাজারে পেট-পূজাটাও সেরে নিলাম সবজি-কোত্তু, ভাত, মরিচ ভর্তা আর ‘সিয়ামবালা’ চিকেন দিয়ে। পানির বোতল নিচে ফেলে পিদুরাঙ্গালে পাহাড়ের ট্রেকটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলেও ট্রেকের শেষভাগে গভীর ঘুমে গৌতম বুদ্ধকে পেয়ে খুশিমনে কান্ডালামা লেকের পাশ দিয়ে সাপের মতো প্যাঁচানো রাস্তা ঘুরে ফিরে আসি হোটেলে। অসম্ভব গরমে ট্রেকের ক্লান্তি মুহুর্তেই কেটে যায় জাকুজিতে শুয়ে প্যানোরামিক জানলা দিয়ে কান্ডালামা লেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে…

প্রবেশ মুখের হাওয়া-সুরঙ্গে লেকের পানির প্রতিফলন
[৩]
কান্ডালামা হোটেলের প্রবেশমুখের হাওয়া-সুরঙ্গে লেকের পানির প্রতিফলনকে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগিয়ে অন্ধকারে আলো নিয়ে আসা, লেকের পানি ব্যবহার না করে পরিবেশ বান্ধব উপায়ে রিসাইকেল্ড পানির ব্যবহার, পাহাড়ের গা-থেকে ‘Stilt’ করে তৈরী করা কাঠামো, স্থাপনার নিচতলা সম্পূর্ণ ফাঁকা করে ‘Wildlife Corridor’ তৈরী করার মতো চমতকার চিন্তাগুলো প্রকৃতিকে ভালোবাসলে, খুব কাছে থেকে নিরীক্ষণ করলে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব। আদতে যেকোন মানবসৃষ্ট স্থাপনাই প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। তারপরও পাহাড়কে পাহাড়ের মতো, বন-কে বনের মতো থাকতে দেয়ার তথাপি প্রকৃতিতে সর্বনিম্ন হস্তক্ষেপের উদাহরণ অনেক রয়েছে যা পাবার জন্য এতো দূরে যেতে হয় না। আমাদের পার্বত্য অঞ্চল গুলোতেই রয়েছে এমন টেকসই এবং প্রকৃতি-বান্ধব স্থাপনা যাকে আমরা সবসময় উপেক্ষা করেছি। চাকমা, মারমা, ম্রু, লুসাই, বম, চাক, খাসিয়া সহ ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে শত-শত বছর ধরে এমন বসতি নির্মাণ করছে যা পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে চমতকার ভাবে অভিযোজিত। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের প্রজন্মান্তরের প্রকৃতিবাসের মাধ্যমে নিখুঁত ভাবে শিখেছে বৃষ্টি, বাতাস আর জঙ্গলকে সাথে করে কিভাবে পাহাড়ে বাস করা যায়। আমরা খুব সহজেই তাদের বসবাস করা বাড়িগুলোর সাথে কান্ডালামার প্রকৃতি-বান্ধব পাঁচ তারকা হোটেলের তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পারি একটি মৌলিক জায়গায় এদের মাঝে অদ্ভুত মিল রয়েছে, সেটি হলো প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে দেওয়ার অসীম ইচ্ছা। দৃশ্যত ‘Stilt Construction’ এর মাধ্যমে মাটি থেকে উঁচু করে তোলা বাড়িগুলো ঢলের পানি আর বন্যপ্রাণীদের অবাধ চলাচলকে উত্সাহিত করে।
আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে প্রকৃতির উপর অন্যায় অত্যাচার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বহু আগে থেকেই। নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে আসবাবের জন্য, দ্রুত বর্ধনশীল বাঁশকেও হুমকীর দিকে ঠেলা হয়েছে। ছড়া আর ঝিড়ি থেকে তোলা হয়েছে পাথর। পাহাড়ি জীবনযাত্রা সম্পর্কে অজ্ঞ সমতলবাসীকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে পাহাড়ে যারা সমতল ভূমির সন্তান বিধায় পাহাড়ের স্লোপ কেটে সমতলভূমি বানিয়ে কার্যত নিজেদের এবং পাহাড়িদের বিপদ ডেকে এনেছে। বিপজ্জনকভাবে পাহাড়ের গোড়ার সমতল জায়গায় বসতি গড়ায় ভূমিধ্বসে সহজেই আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। তাদের সামাজিক আগ্রাসনে পাহাড়ি নির্মাণ-ঐতিহ্য-ও হুমকির সম্মুখীন হয়ে গিয়েছে। এই নির্মাণ-ঐতিহ্যও সংগ্রহ-সংরক্ষণ আবশ্যক। রাস্তাঘাটে নির্মাণের সময় পাহাড়ের মাটির ধরণ, ভূ-প্রাকৃতিক গঠনকে বিবেচনা না করায়, সুচারু-রূপে ড্রেইনেজের ব্যবস্থা না করায় অতি বৃষ্টিতে খুব সাম্প্রতিক সময়ে অকল্পনীয় একটি দুর্যোগ-সময় আমরা পার করেছি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের সরকার এবং ডিফেন্স অ্যানালিস্টরা যেহেতু পাহাড়ে সামরিক স্থাপনা গড়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন, তাই বর্তমানে প্রচুর Heavy Construction বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তৈরী হবে বলে ধারণা করা যায়। এসব স্থাপনা কি ধরণের হবে তা অত্যন্ত Intricate ভাবে চিন্তা করতে হবে। পাহাড়িদের নির্মাণকৌশলের Wisdom থেকে অনেক কিছুই নেবার-শেখার-প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। রাস্তার নির্মাণকৌশল, টিলা বা পাহাড় থেকে নিরাপদ দূরত্ব নির্ধারণ, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকা চিহ্নিতকরণ সহ পাহাড়ের জন্য সুস্পষ্ট বিল্ডিং কোড তৈরী করতে হবে। ‘বাগান’ তৈরী পরিহার করে প্রকৃত ‘Restorative Afforestation’ অনুশীলন অত্যাবশ্যক। এখনই সময় পাহাড়ে কিভাবে স্থাপনা নির্মাণ হবে, কিভাবে করা যাবেনা এ সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরী এবং বাস্তবায়নের…

পার্বত্য এলাকায় ‘ম্রু’ এবং ‘বম’ আবাসন: সূত্র – The Vanishing Traces: Vernacular Architecture of the Chittagong Hill Tracts by Iftekhar Ahmed

কান্ডালামার ‘Stilt Construction’
লেখকঃ রেজা নূর মুয়িন,
স্থপতি, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনার ও প্রকৃতিপ্রেমী।
